শিরোনাম
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৪:৪৪, ৮ আগস্ট ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত
ফলে নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাধারণ ক্রেতারা পড়েছেন চরম বিপাকে। অনেকেই বাধ্য হচ্ছেন প্রয়োজনীয় পণ্যের পরিমাণ কমিয়ে আনতে। বাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে বিক্রেতারা সরবরাহ সংকটের কথা বললেও, ক্রেতাদের অভিযোগ—বাজার মনিটরিংয়ের ঘাটতির সুযোগ নিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা আদায় করা হচ্ছে।
সরকারি সংস্থাগুলোর তথ্য এবং ভোক্তাদের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে স্পষ্ট যে, বাজারে চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যমূলক কাঠামো ভেঙে পড়েছে। এমন বাস্তবতায় অর্থনীতিবিদরা এখনই নীতিগত হস্তক্ষেপ ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে মূল্যস্ফীতির এই ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়।
শুক্রবার (৮ আগস্ট) রাজধানীর একাধিক বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ইলিশ মাছ। বাজারে বড় সাইজের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি দুই হাজার ১০০ টাকা পর্যন্ত। মাঝারি সাইজের ইলিশের দামও এক হাজার ২০০ টাকা থেকে শুরু হচ্ছে। অন্যদিকে রুই মাছ বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৪৫০ টাকায়। আর সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ার কারণে মানুষের ভিড় কিছুটা বেশি, তাই বিক্রেতারা অন্যান্য মাছের দামও চাইছেন বেশি।
করলা, বরবটি, কাঁকরোলের দাম ৮০ থেকে ১২০ টাকা। কাঁচা মরিচ ২০০ থেকে ২৪০ টাকা এবং টমেটো ১৬০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি। বেগুনের দাম কেজিতে ২০-৩০ টাকা বেড়ে ১০০-১৫০ টাকায় উঠেছে। দেশি শসার কেজি ১০০ টাকার বেশি, কচুর ছড়া ৭০ টাকা, চিচিঙ্গা ও ঝিঙ্গে প্রতিকেজি ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আবার মুরগির বাজারেও রয়েছে দামের ঊর্ধ্বগতি। ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৬০ টাকায় পৌঁছেছে, যা সপ্তাহখানেক আগেও ১৪৫-১৫০ টাকার মধ্যে ছিল। পাকিস্তানি মুরগি ৩০০ টাকা এবং দেশি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৫৫০-৬০০ টাকা দামে। খাসির মাংস এখন এক হাজার ২০০ টাকায়, আর গরুর মাংস ৭৫০ টাকা প্রতি কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
প্রোটিনের আরেক উৎস ডিমের দামও বাড়তি। বর্তমানে ফার্মের ডিম প্রতি হালি ৪৬-৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, অর্থাৎ ডজনপ্রতি ১৪০-১৪৫ টাকা।
সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে মসলা ও তেলের বাজারে। সয়াবিন তেল (লুজ) বিক্রি হচ্ছে প্রতি লিটার ১৭২ টাকা দরে; যা গত সপ্তাহে ছিল ১৬২ টাকা। পাম অয়েল ও সুপার পাম অয়েলের দামও বেড়েছে যথাক্রমে ১০ ও ১১ টাকা করে। খোলা ময়দার দাম বেড়ে হয়েছে ৬৫ টাকা কেজি; যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫০-৫৫ টাকা।
ডালের বাজারেও রয়েছে দামের ঊর্ধ্বগতি। মাঝারি মানের মশুর ডাল এখন ১৩৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, ছোট দানার ডাল ১৫৫ টাকা। আর বড় দানার ডাল কিছুটা সস্তায় ৯৫-১১০ টাকা কেজি দরে পাওয়া যাচ্ছে। গত সপ্তাহে এসব ডালের দাম ছিল তুলনামূলক কম।
দেশি পেঁয়াজ এখন ৮৫ টাকা কেজি; যা গত সপ্তাহে ছিল ৬০-৬৫ টাকায়। দেশি রসুন ১৬০ টাকা কেজি, আমদানি করা রসুন ২২০ টাকায়। আদা (আমদানি) বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২৮০ টাকা কেজি দরে। এলাচ কেজিপ্রতি পাঁচ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে; যা আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে।
তবে সব পণ্যের দাম যে বেড়েছে তা নয়। আলুর দাম কিছুটা কমেছে। বর্তমানে মানভেদে প্রতি কেজি আলু ২০ থেকে ৩০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে; যা গত সপ্তাহে ছিল ৩০-৩৫ টাকা।
চালের দামও ঊর্ধ্বমুখী। মাস দেড়েক ধরে উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে চাল। মোটা চালের দামই এখন ৬০ টাকার বেশি। মাঝারি মানের এক ধরনের কিছু মিনিকেট ও নাজির রয়েছে, যেটা শুধু ৬৫-৭০ টাকায় পাওয়া যায়। এ ছাড়া বাকি সব চালের দাম সাধারণত ৭৫-৮৫ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে। আর খুব ভালো মানের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চালের দাম ৯০ থেকে ১০০ টাকা ছুঁইছুঁই করছে।
অন্যদিকে, সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে ময়দা (খোলা), সয়াবিন তেল (লুজ), পাম অয়েল লুজ, সুপার পাম অয়েল লুজ, মসুর ডাল (মাঝারী, ছোট), মুরগী ব্রয়লার পেঁয়াজ (দেশি), রশুন (আম), আদা (আম), এলাচ এবং ডিমের দাম বেড়েছে। আর আলু, রসুন (দেশি), এম এস রডের (৬০, ৪০ গ্রেড) দাম কিছুটা কমেছে।
শান্তিনগরে সরকারি চাকরিজীবী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, মোটামুটি একমাস ধরে সবজির দাম খুব বেশি যাচ্ছে। আজকের বাজারে মনে হচ্ছে আরো একটু বেশি দাম। বেশিরভাগ সবজি ৮০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগে যদি সবজি এক কেজি করে কিনতাম এখন আধা কেজি কিনতে হচ্ছে। কী কারণে দাম বেড়েছে যে সে বিষয় নিয়ে কখনো দেখি না বাজার মনিটরিং হতে। সেই সুযোগে সাধারণ ক্রেতাদের কাছ থেকে সবজি বিক্রেতারা অতিরিক্ত দাম আদায় করছেন।
মালিবাগ বাজারে আরেক ক্রেতা হাবিব আহমেদ বলেন, বাজারে একমাত্র কাঁচা পেঁপে ৪০ টাকা কেজি, বাকি সব ধরনের সবজি ১০০ টাকার ঘরে। এত দাম দিয়ে সবজি কিনে খাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
কী কারণে সবজির দাম এত বেশি জিজ্ঞাসা করলে বিক্রেতারা বলেন, বাজারে একেবারেই সরবরাহ কম সবজির। সে কারণে দাম বাড়তি যাচ্ছে।
রামপুরা বাজারের সবজি বিক্রেতা চাঁদ মিয়া বলেন, পাইকারি বাজারে মাল কিনতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগ সবজির সরবরাহ অনেক কম। মূলত কয়েকদিন বৃষ্টির কারণে ঢাকার পাইকারি বাজারে তুলনামূলক কম সবজি আসছে। সে কারণে একটু দাম বেশি। এ ছাড়া কিছু কিছু সবজির মৌসুম শেষ হয়েছে, নতুন করে সেসব সবজি বাজারে উঠার আগ পর্যন্ত এগুলোর দাম বাড়তি থাকবে। আমরা পাইকারি বাজার থেকে যখন যে দামে কিনতে পারি, খুচরা বাজারে তেমন দামে বিক্রি হয়। যখন কম দামে কেনা পড়বে, তখন আমরাও খুচরা বাজারে কম দামেই বিক্রি করতে পারবো।
খিলগাঁও তালতলা বাজারে ক্রেতা জহির উদ্দিন বলেন, পটোল আর ঢ্যাঁড়স কিনলাম ৬০ টাকা কেজিতে। অন্য কোনো সবজি এর নিচে নেই শুধু পেঁপে ছাড়া। করলা, বরবটি, কাকরোলের দাম ৮০ থেকে ১২০ টাকা চাচ্ছে। প্রয়োজনমতো সবজি কিনে খাওয়াও আমাদের মতো নিম্নবিত্ত মানুষদের ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে।
ইসলামি ব্যাংকের কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান খিলক্ষেত বাজার থেকে গত শনিবার দেশি পেঁয়াজ কিনেছিলেন ৫৫ টাকা কেজি। শুক্রবার একই বাজারে গিয়ে দেখেন, সেই পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকা করে। এক সপ্তাহে প্রতি কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে যাওয়ায় হতবাক তিনি।
তিনি বলেন, এখনই দেশি পেঁয়াজের মজুত শেষ হওয়ার কথা নয়। নতুন মৌসুম আসতে বাকি চার মাস। এখন এভাবে দাম বাড়লে সামনে কী হবে। আমার কার কাছে অভিযোগ দেব। তাদের এই করাসাজির শেষ কোথায়?
কারওয়ান বাজারের ডিম বিক্রেতা রাফি বলেন, দীর্ঘদিন ডিমের তেমন চাহিদা ছিল না। দাম কমে খামারিদের লোকসান হচ্ছিল। তাই অনেক খামারি ডিম উৎপাদন বন্ধ রেখেছেন। এতে বাজারে সরবরাহে টান পড়েছে। ডিমের বাজারে কোনো ব্যালেন্স নেই। মাঝেমধ্যে খামারি লোকসান করেন, আবার কখনো ক্রেতার খরচ বাড়ে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, বাজারের মৌলিক বিষয়গুলো কাজ করছে না। বিশেষ করে সরবরাহব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে। গত মাসে চালের দাম বেড়েছে। এখন চলছে বর্ষা ও বন্যার মৌসুম। এই সময়ে নিত্যপণ্যের ঘাটতি থাকে, যা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিতে পারে। তাই সরকারের উচিত, এখনই প্রস্তুতি নিয়ে পণ্যের চাহিদা ও জোগানে ভারসাম্য আনা। তিনি মনে করেন, শুধু সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।
ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ