শিরোনাম
রায়হান উল্লাহ
প্রকাশ: ০১:৩৭, ১ মে ২০২৫ | আপডেট: ০১:৪১, ১ মে ২০২৫
ছবি: নজরুল ইসলাম খান
দিবসটি উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বাণীতে তিনি বলেন, দেশকে নতুন করে গড়ে তুলতে হলে ঐক্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং আস্থার পরিবেশ সুদৃঢ় করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করতে দেশব্যাপী যথাযোগ্য মর্যাদায় ‘মহান মে দিবস-২০২৫’ পালন করা হচ্ছে জেনে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। তিনি বলেন, এ দিবসে আদায় হয়েছে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার। সে প্রেক্ষাপটে এটি শুধু একটি সাধারণ দিবস নয়, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলন-সংগ্রামের অনুপ্রেরণার উৎস। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার ঐতিহাসিক এ দিনে যাদের আত্মত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে শ্রমিক অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে তাদেরসহ দেশের সব মেহনতি মানুষের প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।
শ্রমিক দিবস উপলক্ষে এক বিবৃতিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেশে-বিদেশে কর্মরত শ্রমজীবী মানুষদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও সংগ্রামী সালাম জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি মহান মে দিবসের ইতিহাস, তাৎপর্য এবং শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য জোরালো আহ্বান জানান।
বুধবার (৩০ এপ্রিল) ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে তারেক রহমান বলেন, আন্দোলনরত শ্রমিকদের আত্মত্যাগ ইতিহাসে অনন্য। তাদের স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। মঙ্গলবার দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে এই আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমেরিকার শিকাগোতে শ্রমিকরা তাদের অধিকারের জন্য আত্মত্যাগ করেছিলেন। সেই অনুপ্রেরণায় বিশ্বের শ্রমিক সমাজ আজও অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সেই আন্দোলন এখনো পুরোপুরি সফল হয়নি। প্রায়শই শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন-ভাতার দাবিতে রাস্তায় নামতে দেখা যায় এবং ন্যায্য পাওনা আদায় করতে গিয়ে অনেককে জীবনও দিতে হয়।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর এবার প্রথমবার ভিন্ন আবহে মে দিবস পালিত হবে দেশে। দিবসটি পালন উপলক্ষে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এবারের মে দিবসের মূল অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। মে দিবস উপলক্ষে আজ বৃহস্পতিবার সকালে সরকারি উদ্যোগে শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত-নিহত শ্রমিকদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করে এবারের মহান মে দিবসের অনুষ্ঠানমালা সাজানো হয়েছে। এদিকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষায় ততপর। এ সরকার শ্রম অধিকার রক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব প্রণয়ণে শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। কমিশন শ্রম বিষয়ে অংশীজন ও বিভিন্ন সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মতবিনিময় করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করেছে।
১৯৮৬ সালের কথা। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা দৈনিক আট ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করেন। তাদের ঘিরে রেখেছিল সশস্ত্র পুলিশ। শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল আন্দোলন। আচমকা পুলিশের উদ্দেশ্যে বোমা ছুঁড়ে কোনো এক অজ্ঞাতনামা। জবাবে নিরস্ত্র শ্রমিকদের ওপর বর্বর হামলা চালায় পুলিশ। আন্দোলন দমাতে তারা গুলি করলে ১১ জন শ্রমিক নিহত হন। আহত ও গ্রেপ্তার হন বহু শ্রমিক। পরে গ্রেপ্তার ছয় শ্রমিককে প্রহসনের বিচারে ফাঁসিও দেওয়া হয়। এতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে পুরো বিশ্বে। অবশেষে দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনগুলোর প্রথম কংগ্রেস। সেখানে পরের বছর থেকে শিকাগো ঘটনার বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব রাখেন রেমন্ড লাভিনে। ১৮৯১ সালে দ্বিতীয় কংগ্রেসে আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয় এই প্রস্তাব।
অবশ্য ১৮৯৪ সালের মে দিবসে ঘটে দাঙ্গা। এরপর ১৯০৪ সালে নেদারল্যান্ডের আমস্টারডামে সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত হয় একটি প্রস্তাব। দৈনিক আট ঘণ্টা কর্মদিবস নির্ধারণের দাবি আদায় এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিবছর পহেলা মে বিশ্বজুড়ে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজন করতে সব সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং ট্রেড ইউনিয়নের প্রতি আহ্বান জানানো হয় ওই প্রস্তাবে।
সম্মেলনে শ্রমিকদের হতাহতের আশঙ্কা না থাকলেও বিশ্বজুড়ে সব শ্রমিক সংগঠন ১ মে ‘বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না-করার’ সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক দেশ এ দিনটি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালনের দাবি জানায়; সেটি কার্যকরও করা হয় কয়েকটি দেশে।
বাংলাদেশসহ প্রায় ৮০টি দেশে যথাযোগ্য মর্যাদায় মে দিবস পালিত হয়ে আসছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় ‘শ্রম দিবস’ পালিত হয় সেপ্টেম্বর মাসে। সেখানকার কেন্দ্রীয় শ্রমিক ইউনিয়ন এবং শ্রমের নাইট এই দিন পালনের উদ্যোক্তা।
হে মার্কেটের হত্যাকাণ্ডের পর যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড ধারণা করেছিলেন, পহেলা মে’র যেকোনো আয়োজন সংঘাতে রূপ নিতে পারে। সে কারণে ১৮৮৭ সালে তিনি নাইটের সমর্থিত শ্রম দিবস পালনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। সেই প্রথা কিংবা রেওয়াজ এখনো চলে আসছে।
দিনটি একইসঙ্গে শোক ও আনন্দের। কারণ এ দিনে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু শ্রমিকের রক্ত, ক্ষোভ ও বিষ্ফোরণের ফসল ভোগ করছেন সারা বিশ্বের অসংখ্য শ্রমিক। আগামীর শ্রমিকরাও ভোগ করবেন; অজানা সময় পর্যন্ত।
দিনটি জাতীয় ছুটির দিন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠন রাজপথে সংঘবদ্ধ মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে দিবসটি পালন করে। শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামে অনুপ্রেরণার উৎস এই দিবসটি মালিক-শ্রমিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠারও দিন। শ্রমিকদের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটারও দিন এটি।
শ্রমিক ও শ্রম সংশ্লিষ্টরা আশা করেন- সকল শঙ্কা ও ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে মুক্তি মিলবে একদিন। তার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে দেশ ও বিশ্বের প্রতিটি মানুষ। আসবে আবার নতুন প্রভাত। মুষ্টিবদ্ধ হাত ওপরে উঠবে। শ্রম দিবসের লড়াইও সার্থক হবে। মে দিবস কেবল একটি উৎসবের দিন নয়, এটি একটি প্রতিজ্ঞারও দিন। সেই প্রতিজ্ঞা হলো, পৃথিবীর তাবৎ মেহনতি মানুষের শোষণ মুক্তির লড়াই।
মহান মে দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে শ্রমিক সমাবেশ, শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
মহান মে দিবস উদযাপন উপলক্ষে জাতীয় পত্রিকাসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতার ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো দিনটি উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান ও টকশো সম্প্রচার করছে।