শিরোনাম
রায়হান উল্লাহ
প্রকাশ: ১২:২৬, ১ মে ২০২৫ | আপডেট: ১২:৫৩, ১ মে ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত
মগবাজার মোড়ে কথা হয় আজমেরি পরিবহনের হেলপার মামুন মিয়ার সঙ্গে। আজ শ্রমিক দিবস কাজে বের হয়েছেন কেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমরা কাজে না বের হলে আপনারা এখন গাড়ি পাইতেন কেমনে? আর শ্রমিক মানুষ দিন বা দিবস দিয়া কী করমু? কাম করলে খাইতে পারুম। না করলে খাওন দিব কেডা?
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় বাড়ি সোহরাব খানের। কারওয়ান বাজারে মিন্তির কাজ করেন। বাড়িতে স্ত্রী, দুই মেয়ে, ছেলে ও ছেলের বৌ আছে। ছেলে ও তার স্ত্রীর আলাদা সংসার। অনেক কষ্টে অর্থ জোগাড় করে বড় মেয়ের বিয়ে দিতে পারলেও অর্থাভাবে আরেক মেয়ের বিয়ে দিতে পারছেন না।
আয় কম হওয়ায় বিয়ে দিতে পারছেন না বলে জানান সোহরাব খান। দিনে ৩০০-৪০০ টাকা রোজগার নিয়ে কোনো রকম নিজে টিকে থেকে পরিবারের হাল ধরেছেন। সেই সঙ্গে বড় মেয়ে ও জামাইয়ের সহযোগিতায় সংসার কোনো মতে চলে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
সোহরাব খান বলেন, ‘৪৩ বছর ধরে কাজ করছি। আগে দিনে ১৫০ টাকা ইনকাম করলেও তা দিয়ে ভালোভাবে সংসার চলে যেতো। এখন সারা দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা ইনকাম করি। তা দিয়েও সংসার চলে না। তা ছাড়া এখন ১৫০ টাকা ইনকাম করতেই অনেক কষ্ট হয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘আগে তেজগাঁও রেলস্টেশন কোয়াটারে থাকতাম। ২০-২২ বছর ধরে আলুর আড়তেই থাকি। থাকার জায়গাও লাগে না; রাত হলেও কাম করা লাগে, দিন হলেও কাম করা লাগে। দিনরাত খাটি, যাই ইনকাম হয়। এর মধ্যে ঘুম পাড়ার কোনো টাইম নাই। এই দিয়ে নিজে চলি, সংসার চালাই।’
আজ মে দিবস এটি জানেন কি প্রশ্নে তিনি বলেন, মে দিবস মানে কী? আমরা গরীব ও মুর্খ মানুষ; এমন দিন দিয়া কী করমু?
আজকের দিনে মালিবাগ রেললাইনে কাজের আশায় দাঁড়িয়ে ছিলেন কাইয়ুম। সকাল ৯টায় তার কাছে জানতে চাওয়া হয় এমন দিনে কাজে এসেছেন কেন? তিনি বলেন, আমাদের কাছে সব দিনই সমান। আর কামে না আইলে খামু কী? মে দিন না কী এটি পালন করলে আমাদের চলে না। ভাত খাইতে কাম পাওয়া লাগব। আজ যদি কাম না পাই তাইলে ঘরের মানুষ না খাইয়া থাকব।
উত্তরার আবদুল্লাহপুরে কথা হয় গার্মেন্টসকর্মী শাহানা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, দিবস ধরে আমাদের জীবন চলে না। আমরা কতই বা অর্থ পাই? এই টাকায় সংসার চলে না। এইসব দিবস পালন করে কী আমাদের জীবন বদলেছে?
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ৬৫ নম্বর ওয়ার্ডে প্রখর রোদে বহুতল ভবনের নির্মাণকাজ করছিলেন মোবারক হোসেন। তার কাছে মে দিবস বলতে কিছু নেই। একদিন কাজ না করলে পরের দিনে তার সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। মোবারক হোসেন বলেন, মে দিবস এসব জেনে আমাদের লাভ অইব কী? সব দিনই আমরার লাগি সমান। বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য রড কাটতে কাটতে এসব কথা বলেন মোবারক হোসেন।
যুগের পর যুগ মে দিবস পালন হলেও বহু শ্রমিক জানেন না তাদের আজ ছুটির দিন। প্রতিদিনের মতোই আজও তারা দিনমজুরের কাজে নেমেছেন। অধিকার নিয়ে তারা ভাবেন না। তারা শুধু ভাবেন কাজ না করলে সংসার চলবে না।
কাজল সরকারের বাড়ি ফরিদপুর। তিনি কাপ্তানবাজারে দীর্ঘ সাড়ে ১২ বছর ধরে মুদির দোকানে কাজ করেন। তার পাঁচ সদস্যের সংসারের খরচ জোগান। ৫৫ বছর বয়সে অনেক ভারী বস্তা কাঁধে তুলতে তুলতে কাঁধ দুটি শক্ত হয়ে গেছে। পরিবার ও সন্তানদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য এই হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরও তিনি এক দিনের জন্যও বসে থাকেন না। বড় বড় বস্তা কাঁধে তার প্রতিদিন ৮০০ টাকা আয় হয়। এ দিয়েই তার সংসার চলে।
তিনি বলেন, আমাদের কোনো দিন বসে থাকলে হয় না। কবে কোন দিক দিয়ে দিবস যায়, সেই খোঁজ রাখি না। আর দিবসের কথা মাথায় রেখে যদি বসে থাকি তাহলে খাবার জুটবে না।
খিলগাঁওয়ে একটি বহুতল ভবনে কাজ করছিলেন রাজমিস্ত্রি মশিউর রহমান। মশিউর বলেন, ভাত জোগানের চিন্তায় সব সময় অস্থির থাকি। মে দিবস কী, বলতে পারি না। আর বলেই বা লাভ কী? শ্রমিকদের খোঁজ-খবর কে রাখে? দিন দিন বাজারের জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বাড়ছে, সেভাবে কি শ্রমিকদের মজুরি বাড়ছে? সে জন্য সারাদিন ঘাম ঝরিয়ে কঠোর পরিশ্রম শেষে পরের দিনের রোজগারের কথা চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ি। কোন দিক দিয়ে রাত শেষ হয়ে যায়, তাও টের পাই না। কাজ করে যে টাকা পাই তা দিয়ে টিকে থাকাই কঠিন।
এমন দুঃখ ও ক্ষোভের ক্ষরণ চলছেই। যতদিন না শ্রমিক তার প্রকৃত মজুরি পাবেন ততদিন চলবেই। সংশ্লিষ্টরা বলেন, দেশে আট কোটি শ্রমজীবী মানুষ আছেন। তার মধ্যে ৮৫ শতাংশ বা সাত কোটি শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা নেই।
এর মাঝে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২৪ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, দেশে বেকার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে শ্রমশক্তির ২৬ লাখ ৬০ হাজার মানুষ বেকার ছিলেন। বেকারের হিসাব ১৯তম আইসিএলএস (পরিসংখ্যানবিদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন) অনুযায়ী প্রস্তুত করে বিবিএস। এই পদ্ধতি অনুসারে যারা উৎপাদনমূলক কাজে নিয়োজিত থাকেন, কিন্তু বাজারে পণ্য বা সেবা বিক্রি করেন না, তারা কর্মে নিয়োজিত নন হিসেবে ধরা হয়। তারা বেকার জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত হন। বেরসকারি হিসাবে বেকারের সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে বেশি।
সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, বৈষম্য কমার কোনো লক্ষণও দেখছি না। আমাদের দাবি শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি মাসিক ৩০ হাজার টাকা। কিন্তু তাদের মজুরি এর ধারেকাছে নেওয়ার চেষ্টাও নেই।
গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে সাভার এলাকায় নিহতদের বেশির ভাগই শ্রমজীবী মানুষ। কিন্তু তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
মহান মে দিবস উপলক্ষে বুধবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মানবাধিকার এবং শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করা অন্তর্বর্তী সরকারের লক্ষ্য। আর এজন্য মালিক ও শ্রমিক সবার সহযোগিতা দরকার। শ্রম উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার শ্রমিকদের কল্যাণে অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে। কর্মসংস্থান অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে। সেখান থেকে শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। তবে শ্রমিক অসন্তোষ সামাল দিতে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে সরকারকে। শ্রম আইনে অনেক পরিবর্তন আসবে, যা আমাদের মেয়াদকালেই বাস্তবায়ন করব।
জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার শ্রম অধিকার রক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব প্রণয়নে শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। গত ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিআইএলএস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে ১০ সদস্যের একটি শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন শ্রম বিষয়ে অংশীজন ও বিভিন্ন সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মতবিনিময় করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে শ্রম সংস্কার কমিশন ২১ এপ্রিল তাদের প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন। শ্রম আইন মেনে শ্রমিককে চাকরিচ্যুত/ছাঁটাই করা না হলে মালিকের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে শ্রম সংস্কার কমিশন।
ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ