ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫

১৮ বৈশাখ ১৪৩২, ০৩ জ্বিলকদ ১৪৪৬

চলচ্চিত্রে নিরন্ন বিপন্ন মানুষ

বিনোদন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৪:৫১, ১ মে ২০২৫

চলচ্চিত্রে নিরন্ন বিপন্ন মানুষ

‘জনমজুর খাটতাম... তো কাজকম্মো নেই... জনমজুর জনমজুর’ বলে নিজেকে চেনাতে থাকেন মানুষটি। যাঁদের বলছিলেন, তাঁরাও শ্রমিকের দল, হেঁটে আসছিলেন বহু দূর থেকে, তাঁদের মধ্যেই কেউ একজন বলে ওঠেন, ‘পাগল’। শুনে এই মানুষটিও সায় দেন, ‘লোকে তাই বলে বটে... দেশের যা অবস্থা, তাতে ঠিক থাকে মাথা?’ তাঁকে নিয়েই এগোতে থাকে শ্রমিকের দল, একজন গেয়ে ওঠেন আর বাকি সকলে তাতে গলা মেলান: ‘হম ভুখসে মরনেওয়ালে, কেয়া মওতসে ডরনেওয়ালে...’।

দীর্ঘ পথ পেরিয়ে আসছিল শ্রমিকের দলটি। অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন ছ’মাস যাবৎ, তাঁদের ন্যূনতম মজুরি দেওয়ার রায় বেরিয়েছে, তবু মালিকপক্ষ মানেনি, শ্রমিকদের বাধ্য করেছে ধর্মঘটে যেতে। পথ-হাঁটা সেই শ্রমিকের দলটিকে রাস্তায় আটকান বকুলপুর গ্রাম থেকে আসা জনকয়েক কৃষক, ‘কিছু মুড়ি আর খেতের শসা এনেছি... আর কিছু করা গেল না, আমরা বড় গরিব... দয়া করে যদি এই যৎসামান্য...’। শুনে দলের এক জনের চোখ ভরে আসে জলে, অন্য জন গিয়ে জড়িয়ে ধরেন তাঁদের। তার পর আবার হাঁটতে শুরু করেন তাঁরা, গলায় সেই একই গান: ‘হম ভুখসে মরনেওয়ালে, কেয়া মওতসে ডরনেওয়ালে...’

সত্তর দশকের মাঝামাঝি তৈরি মৃণাল সেনের ‘কোরাস’ ছবিটা ৫০ বছর পেরিয়েও কেমন প্রাসঙ্গিক! আসলে এই অমানবিকতা তো বরাবরের, নীরবে ফুলেফেঁপে উঠেছে বহু কাল ধরে। দাসত্ব যেন নিত্যসঙ্গী খেটে-খাওয়া শ্রমিকদের- তাঁদের খেতেও দেওয়া হচ্ছে না, জোর করে আটকেও রাখা হচ্ছে।

আশির দশকের গোড়ায় মৃণাল সেনের আকালের সন্ধানে মনে পড়ে? সে ছবিতে দুর্গাকে? দু’মাসের অসুস্থ বাচ্চাকে ফেলে তার গ্রামে মন্বন্তরের ছবি তুলতে আসা ফিল্ম-ইউনিটে কাজ করতে যেত সে রোজ, প্রতি দিন সাত টাকা করে পেত, সঙ্গে এক বেলার খাবার। ছবির নায়িকা মানবিকতাবশতই তাকে ছেলের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেন এই আশ্বাসে যে তার দৈনিক মজুরি কাটা যাবে না। তাতে অবশ্য তার ভয়ঙ্কর অভাব ঘোচে না। সেই দুর্গা এক রাতে দুর্ভিক্ষের শুটিং দেখে এসে হাঁড়িতে দু’মুঠো চাল চাপিয়ে স্বামীকে প্রশ্ন করেছিল, ‘আচ্ছা তুমি আকাল দেখেছ?’ তার পর অবশ্য নিজেই বলে, ‘তুমি কী করে জানবে, সে তো অনেক কাল আগের কথা...’, সংলাপ প্রায় শেষ হতে-না-দিয়েই পরের দিন সকালের বাজারে আমাদের টেনে আনেন মৃণাল সেন— অফুরান খাদ্যসামগ্রী, থরে থরে সাজানো আনাজ মাছ ডিম...

আমাদের বেঁচে থাকার অসঙ্গতিকে বার বার এমন ভাবে ফিরিয়ে এনেছেন চলচ্চিত্রের পরিচালকরা। সেসব ছবি হয়তো বড় অস্বস্তিতে ফেলে দেয় বড়লোকদের। দেশে খাদ্যের প্রাচুর্য সত্ত্বেও বহু মানুষ ক্ষুধার্ত থাকতে বাধ্য হয়, কেন? বাজারে খাবারের জোগান আছে, এক দলের দখল আছে সেই খাবারের উপর, অথচ অধিকাংশেরই তা নেই বলে অর্ধাহার-অনাহার তাদের নিত্যসঙ্গী। ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘পদাতিক’, ‘মৃগয়া’, ‘ওকা উরি কথা’, ‘পরশুরাম’, ‘একদিন প্রতিদিন’, ‘খারিজ’, ‘জেনেসিস’, ‘মহাপৃথিবী’... পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্রে যেভাবে শ্রমিক শ্রেণীকে নিয়ে একটা সময় কথা বলা হয়েছে, সেটা পৃথিবীতে বিরল। এত গভীরভাবে শ্রমিকদের নিয়ে হলিউড ছাড়া আর কোনো ইন্ডাস্ট্রি বলেনি। 

বিশ্ব চলচ্চিত্রে মে দিবস

শিল্প বিপ্লবোত্তর সময়ের এক শ্রমিক যান্ত্রিকতা, চাকরির চাপ ও সমাজের পুঁজিবাদী কাঠামোর সঙ্গে লড়াইয়ের গল্প উঠে এসেছে ‘মডার্ন টাইমস’ সিনেমায়। এটি একইসঙ্গে হাস্যরসাত্মক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তীক্ষ্ণ একটি সিনেমা। সিনেমায় চ্যাপলিন যান্ত্রিক সমাজে শ্রমিকের অবস্থা ও আত্মসংকটকে দারুণভাবে তুলে ধরেছেন।

শ্রমিকদের নিয়ে ‘মেইটওয়ান’ হলিউডের বিখ্যাত একটি সিনেমা। মেইটওয়ান যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের একটি শহর। ১৯২০ সালের এক কয়লাখনি নিয়ে ‘মেইটওয়ান’ ছবির কাহিনি। কয়লাশ্রমিকেরা ইউনিয়নে যূথবদ্ধ হয়ে ডাক দেন ধর্মঘটের। তাঁদের দাবি ছিল কাজের পরিবেশ উন্নত করা আর মজুরি বাড়ানোর। জন সেইলেসের পরিচালনায় ছবিটিতে অভিনয় করেছেন ক্রিস কুপার, জেমস আর্ল জোনস, ম্যারি ম্যাকডোনাল।

ক্রিস্টাল লি সুটনের জীবনের সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হয়েছে ‘নরমা রে’। পোশাকশিল্পকর্মী থেকে ইউনিয়ন নেতা হয়ে যাওয়া ক্রিস্টাল লি সুটনের জীবনের সত্য ঘটনা অবলম্বনেই তৈরি হয়েছে সিনেমাটি। পরিচালক মার্টিন রিট। ছবিতে নরমা চরিত্রে অভিনয় করেছেন স্যালি ফিল্ড। এ ছবিতে অভিনয়ের জন্য তিনি অস্কারজয়ী হন। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭৯ সালে।

‘অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট’ বারবার দেখা যায়। ইলিয়া কাজান পরিচালিত এই ছবির মূল আকর্ষণ মার্লোন ব্রান্ডোর অসাধারণ অভিনয়। আরও অভিনয় করেছেন কার্ল ম্যালডেন, লি জে কব। টেরি ম্যালয় একজন যোদ্ধা হতে চান। কিন্তু একটি খুন থেকে উঠে আসেন শ্রমজীবী মানুষদের গল্প। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৫৪ সালে।

ভিট্টোরিও ডি সিকা পরিচালিত ‘দ্য বাইসাইকেল থিফস’ ইউরোপের নিউ ওয়েভের অন্যতম দৃষ্টান্ত। ফ্যান্টাসির বাইরে গিয়ে জীবনঘনিষ্ট সিনেমা হিসেবে রয়েছে এর আলাদা কদর। গরীবের জীবনের ক্ষুদ্র সংকটও কতটা গভীর হতে পারে তার এতো জীবন্ত রূপ এরআগে সিনেমায় খুব একটা দেখা যায়নি। রোম শহরে এক দরিদ্র শ্রমিকের বাইসাইকেল চুরি হয়ে যায়, যা তার একমাত্র উপার্জনের মাধ্যম। সে ও তার ছোট ছেলে সেই বাইসাইকেল খুঁজতে শহরজুড়ে ঘুরে বেড়ায়।

এক মধ্যবিত্ত পরিবারের পিতা অনলাইন ডেলিভারি ড্রাইভার হিসেবে কাজ শুরু করে। ‘সেলফ-এমপ্লয়ড’ নামের প্রতারণামূলক ব্যবস্থার কারণে তার পরিবার একে একে ভেঙে পড়ে। আধুনিক গিগ ইকোনমি ও শ্রমিক শোষণের দুর্দান্ত পোট্রে ‘সরি উই মিসড ইউ’ ছবিটি।

বাংলাদেশি সিনেমায় শ্রমিকরা

বাংলাদেশের অসংখ্য চলচ্চিত্রে শ্রমিকদের শোষিত জীবনের গল্প ওঠে এসেছে। গেল কয়েক বছরে যেসব সিনেমা নির্মাণ হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম রুবাইয়াত হোসেনের ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’। পোষাক শ্রমিকদের জীবনসংগ্রাম নিয়ে নির্মিত সিনেমাটি দেশের বাইরেও প্রশংসিত হয়েছে। চা শ্রমিকদের জীবন নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘ছায়া বৃক্ষ’। চা-বাগানের শ্রমিকদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ও নিত্যদিনের গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রটি। বাংলার অবহেলিত তাঁতশিল্পের গল্প নিয়ে নির্মাণ হয়েছে ‘লাল শাড়ি’। 
‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘ভাত দে’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’, ‘বিক্ষোভ’, ‘বিদ্রোহ চারদিকে’সহ আরও অনেক সিনেমাতেই মেহনতি মানুষের সংগ্রাম ফুটে উঠেছে।

বলিউডে শ্রমিকদের নিয়ে সিনেমা

শ্রমিক জীবনের প্রতিচ্ছবি ও লড়াই উঠে এসেছে বলিউডের কিছু ব্যতিক্রমী ছবিতে। ‘দো বীঘা জমিন’ (১৯৫৩), ‘শ্রী ৪২০’ (১৯৫৫), ‘নয়া দৌড়’ (১৯৫৭), ‘কালা পাথর’ (১৯৭৯), ‘সালাম বম্বে!’ (১৯৮৮), ‘ব্যান্ডিট কুইন’ (১৯৯৪) ইত্যাদি ছবিগুলোতে শ্রমিকদের গল্প এসেছে বৈচিত্রতা নিয়ে।

বাংলাদেশের গানে শ্রমিকরা

‘নাম তার ছিল জন হেনরি, ছিল যেন জীবন্ত ইঞ্জিন। হাতুড়ির তালে তালে গান গেয়ে শিল্পী, খুশি মনে কাজ করে রাত-দিন...।’ বাংলাদেশের পপ মিউজিকের পঞ্চপাণ্ডবের একজন ফকির আলমগীর গেয়েছিলেন এই গান। গণশিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কথা ও সুরে গানটি কণ্ঠে কণ্ঠে মিশে গেছে ফকির আলমগীরের সঙ্গে। শ্রমজীবী মানুষের গান মানেই হয়ে উঠে ফকির আলমগীরের গান। তার তেজোদীপ্ত কণ্ঠের আবেদন মানুষকে নাড়িয়ে দেয়। ফকির আলমগীরের গাওয়া ‘ও সখিনা গেসস কি না ভুইলা আমারে’ গানটি তাই আজও এ আবেদন রাখে। এ ছাড়া জারি-সারি গানগুলো গ্রামবাংলার শ্রমজীবীদের মাঝ থেকেই উঠে আসা। সারি বেঁধে গান গাওয়া হয় বলেই এই গানকে সারি গান বলা হয়, যা বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। যেমন, ‘আল্লাহয় বলিয়া রাও খোল রে’। ভাটি অঞ্চলের গানে উঠে আসে মাঝিদের গল্প। আর গানের নাম হয় ভাটিয়ালি। যেমন, কে যাও ভাটির দেশের নাইয়ারে ভাই।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এভাবেই বিভিন্ন পেশার সঙ্গে মিশে আছে নিজেদের গান, যার সঙ্গে শ্রমজীবী মানুষের আনন্দ-বেদনা-হাসি-কান্না লুকিয়ে আছে।

আরও পড়ুন