শিরোনাম
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৮:৪০, ২৩ জুন ২০২৫ | আপডেট: ১৮:৪৯, ২৩ জুন ২০২৫
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ইরানের ভূখণ্ডে ইসরায়েল ও আমেরিকার হামলা পরে আশ্চর্যজনকভাবে নীরব রয়েছে বাংলাদেশের মুসলিম সমাজ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও খুব একটা সাড়া নেই, ইসলামী সংগঠন, রাজনৈতিক দলগুলো থেকেও জোরালো প্রতিক্রিয়া আসেনি। এমনকি বায়তুল মোকাররমে কোথাও কোনো উল্লেখযোগ্য মিছিল বা বিক্ষোভও দেখা যায়নি।
এই প্রশ্ন সামনে এনে অনেকেই বলছেন—ইরান একটি শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, আর বাংলাদেশে ইসলামী চেতনার মূলধারায় সুন্নি ও বিশেষ করে দেওবন্দি ও সালাফি চিন্তাধারা প্রবল। ফলে এক ধরনের সুপ্ত মতাদর্শগত দূরত্ব থেকেই বাংলাদেশের মুসলিমরা ইরানের ব্যাপারে আগ্রহী নন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বরাবরই শিয়া-সুন্নি ইস্যুতে বিভক্ত থেকেছে, এ নিয়ে প্রতিনিয়ত তাদের রক্তাক্ত সংঘাতের ঘটনা ঘটে৷ বিশ্বের দেড়শো কোটি মুসলমানের মধ্যে ৮৫-৯০ ভাগ সুন্নি সম্প্রদায়ের বলে ধরে নেয়া হয়৷ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে মিশর, জডার্ন আর সৌদি আরবে সুন্নিদের হার নব্বইভাগের মতো৷ অন্যদিকে ইরান, ইরাক, বাহরাইন, আজারবাইজান আর ইয়েমেনে শিয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠ৷
এই অঞ্চলে শিয়া মতবাদ প্রচারিত হয় সতেরো শতকের প্রথম ভাগে পারস্যের বনিক ও পর্যটকদের মাধ্যমে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশে শিয়াদের সংখ্যা দশ লাখের মতো। এরমধ্যে ঢাকায় বাস করেন দুই লাখ। আপাতদৃষ্টিতে দেশে শিয়া আর সুন্নিদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। ধর্মীয় ভাষ্যে ইরানের শিয়া চিন্তাধারাকে ভিন্ন, এমনকি বিভ্রান্তিকর বলেও উল্লেখ করে থাকেন অনেকে। বাংলাদেশের অনেক ওয়াজিন, ইসলামি বক্তা এবং ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলের বক্তব্যেও ইরানের রাজনৈতিক ইসলামের ব্যাখ্যা ও কার্যক্রমকে প্রায়শই প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়।
একটা সময় ‘উম্মাহ’র ঐক্যের কথা সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হতো মুসলিম বিশ্বে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইসলামী উম্মাহ নিজেই এখন মতাদর্শ ও রাজনীতির ভিন্ন পথে বিভক্ত। শিয়া-সুন্নি বিরোধ শুধুই মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা নয়, এর ছায়া পড়েছে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সমাজেও।
বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনীতির মূলধারা—যেমন জামায়াতে ইসলামী কিংবা হেফাজতে ইসলাম—ইরানের ইসলামী বিপ্লব বা শিয়া রাজনৈতিক তত্ত্বের সমর্থক নয়। বরং বহু সময় দেখা গেছে, তাঁরা ইরানকে ইসলামি ঐক্যের পথে ‘বিভ্রান্তিকর’ বলেই দেখিয়েছেন। এ ছাড়া রিয়াদের প্রভাব বাংলাদেশের ইসলামী পরিমণ্ডলে দৃশ্যমান। সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যকার কূটনৈতিক ও মতাদর্শিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশেও ছায়া ফেলে রেখেছে।
সরকারি পর্যায়েও ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের অবস্থান বরাবরই নিরপেক্ষ ও পরিমিত। বাংলাদেশ সরকার মূলত মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বিশাল শ্রমিক বাহিনী, অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও সৌদি প্রভাবের বিষয়টি মাথায় রেখেই কৌশলী নীরবতা বজায় রাখে। আর সরকারের কৌশল অনেক সময় সাধারণ মানুষ ও ইসলামি সংগঠনগুলোতেও প্রভাব ফেলে।
ইরানের নিজস্ব ভূরাজনৈতিক হিসাব, সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ সরকারকে সমর্থন, ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের সহযোগিতা—এসব কারণে ইরানের ভূমিকা নিয়ে মুসলিম বিশ্বের একাংশ বিভ্রান্ত। বাংলাদেশের অনেক মুসলমান এখনো জানেন না ইরানে কেনো হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল, ইরানের পররাষ্ট্রনীতি আসলে কী ধরনের। এর বিপরীতে ফিলিস্তিন কিংবা রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রতিপক্ষ স্পষ্ট হওয়ায় বাংলাদেশি মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া জোরালো হয়ে ওঠে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক ধর্মীয় শিক্ষায় শিয়া মতবাদকে প্রায় অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়। ওয়াজ মাহফিলে প্রকাশ্যেই শিয়া বিরোধী বক্তব্য উঠে আসে। এই দীর্ঘদিনের মতাদর্শিক ব্যবধান এখন ফল দিচ্ছে ‘নীরবতা’র মাধ্যমে। একজন ধর্মবিশারদ বলেন, “আমরা ফিলিস্তিনের জন্য কাঁদি, রোহিঙ্গাদের জন্য মিছিল করি—কারণ তারা সুন্নি, আর আমরা তাদের আপন মনে করি। কিন্তু ইরানের মতো একটি শিয়া রাষ্ট্র আক্রান্ত হলেও আমাদের ভিতরে নাড়া লাগে না। এটা এক ধরনের মতাদর্শিক পক্ষপাত।”
একজন মুসলমান হিসেবে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে মুসলিম নিপীড়িত হলে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ধর্মীয় ও মানবিক দায়িত্ব। শিয়া না সুন্নি—এ বিভাজন যতোদিন না পেরোনো যায়, ততদিন মুসলিম উম্মাহর ঐক্য শুধুই কাগজে থাকবে। বাংলাদেশের মুসলমানদের উচিত ইরান প্রসঙ্গে মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠে অন্তত মানবিক অবস্থান নেওয়া।
ঢাকা এক্সপ্রেস/ এমআরএইচ