শিরোনাম
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:১৩, ২৪ জুন ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন এলাকায় মশা নিয়ন্ত্রণে চেষ্টার ঘাটতি, জমে থাকা পানির অপসারণে অবহেলা এবং বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব— এই তিনটি বড় কারণ একত্র হয়ে এডিস মশার বিস্তারকে ত্বরান্বিত করছে। রাজধানীতে কিছুটা হলেও মশক নিধনের কার্যক্রম চোখে পড়ে, কিন্তু ঢাকার বাইরের জেলাগুলোর বাস্তবতা ভিন্ন। সেখানে কার্যত কোনো প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি নেই, যার ফলে ডেঙ্গু সংক্রমণের হার অনেক বেশি।
চিকিৎসাব্যবস্থার অপ্রতুলতা আরো বিপদ বাড়াচ্ছে। ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে ডেঙ্গু চিকিৎসার পরিকাঠামো না থাকায় অধিকাংশ রোগী রাজধানীতে ছুটে আসছেন। এর ফলে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে চাপ বাড়ছে এবং মারাত্মক রোগীদের সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা কঠিন হয়ে উঠছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে চিকিৎসাসেবার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে এবং স্থানীয় পর্যায়ে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) জানায়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি, মার্চ এবং মে মাসে তারা যে জরিপ করেছে, তাতে দেখা গেছে, ঢাকার বাইরেও এডিস মশার বিস্তার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এই জরিপে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ছাড়াও চট্টগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহী সিটি করপোরেশন এবং কুষ্টিয়া, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, ঝিনাইদহ ও মাগুরা পৌরসভাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন জানান, জরিপে দেখা গেছে ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলায় এডিস মশার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। বরিশাল বিভাগের বরগুনা জেলাতেও ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়ছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ হলো— স্থানীয় মানুষের পানির সংকট। সেখানে নোনা পানির কারণে খাওয়ার পানি বড় বড় পাত্রে সংরক্ষণ করতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই পাত্র খোলা থাকে বা কাপড় দিয়ে ঢাকা হলেও তা পুরোপুরি মশা প্রতিরোধে সক্ষম নয়। ফলে সেখানে এডিস মশা জন্ম নিচ্ছে এবং সংক্রমণ ছড়াচ্ছে।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার জানান, এবার শুধু রাজধানী নয়, দেশের প্রতিটি জেলায় ডেঙ্গুর বিস্তার দেখা যাবে। তবে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরগুনা ও বরিশালে সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, ছোট-বড় প্লাস্টিক পাত্র, প্যাকেট, ফেলে রাখা কনটেইনারে জমা বৃষ্টির পানি, অকার্যকর মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এবং জলবায়ু পরিবর্তন একসঙ্গে মিলে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটাচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. মুস্তাক হোসেন বলেন, জরিপে দেখা যাচ্ছে, ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠছে। ঢাকার বাইরের রোগীরা বাধ্য হয়ে রাজধানীতে ছুটে আসছেন, কারণ সেখানকার স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো পর্যাপ্ত নয়। ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার কমাতে হলে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীভূত করতে হবে। উপজেলা ও জেলা হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গুর প্রাথমিক ও সেকেন্ডারি চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখতে হবে। বিশেষ করে গর্ভবতী নারী, বয়স্ক, ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীদের সেকেন্ডারি পর্যায়ে পর্যবেক্ষণে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে গুরুতর অবস্থার আগেই চিকিৎসা দেওয়া যায়।
সোমবার (২৩ জুন) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুমের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ডেঙ্গুতে দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। এক দিনে নতুন করে ৩৯২ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১২৬ জন, চট্টগ্রামে ৮০ জন, ঢাকার বাইরে ৩১ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ২২ জন, দক্ষিণ সিটিতে ৬২ জন, খুলনায় ২৫ জন, রাজশাহীতে ৪১ জন, ময়মনসিংহ ও রংপুর বিভাগে একজন করে রোগী ভর্তি হয়েছেন।
আরো জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ২৬০ জন রোগী চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন। এখন পর্যন্ত চলতি বছরে মোট আট হাজার ১৫০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৫৯ শতাংশ পুরুষ এবং ৪১ শতাংশ নারী। চলতি বছরের শুরু থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যু হয়েছে ৩৪ জনের।
সার্বিকভাবে চলতি বছরের ডেঙ্গু সংক্রমণের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জানুয়ারিতে আক্রান্ত হন এক হাজার ১৬১ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭৪ জন, মার্চে ৩৩৬ জন, এপ্রিল মাসে ৭০১ জন, মে মাসে এক হাজার ৭৭৩ জন এবং জুন মাসের প্রথম ২৩ দিনেই আক্রান্ত হয়েছেন তিন হাজার ৮০৫ জন।
তুলনামূলকভাবে, ২০২৪ সালে মোট এক লাখ ১ হাজার ২১৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং মৃত্যু হয়েছিল ৫৭৫ জনের। তার আগের বছর ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল এক হাজার ৭০৫ জনের। এসব পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৫ সালেও ডেঙ্গুর ভয়াবহতা থেকে দেশ খুব একটা রেহাই পাবে না—যদি না এখনই প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়।
ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ