ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই ২০২৫

৮ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৭ মুহররম ১৪৪৭

শিরোনাম

Scroll
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিমান বাহিনী প্রধানের সাক্ষাৎ
Scroll
বিমান বিধ্বস্তে প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করে তালিকা প্রস্তুত করতে কমিটি গঠন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের
Scroll
শোকের সময় শান্ত ও সংহত থাকুন, জনগণের উদ্দেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান
Scroll
শক্তিশালী পাসপোর্ট তালিকায় সিঙ্গাপুর শীর্ষে, বাংলাদেশ ৯৪তম
Scroll
এইচএসসির ২২ ও ২৪ জুলাইয়ের স্থগিত পরীক্ষা একদিনে হবে: শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার
Scroll
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মাসুকা বেগম নিপু
Scroll
টি-টোয়েন্টি সিরিজে পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করতে চান বাংলাদেশি ব্যাটার জাকের আলী
Scroll
হেভি মেটাল কিংবদন্তি ওজি ওসবার্ন আর নেই

মাইলস্টোনের শিক্ষকের বর্ণনায় বিমান বিধ্বস্তের সেই মুহূর্ত

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ১৪:২১, ২৩ জুলাই ২০২৫

মাইলস্টোনের শিক্ষকের বর্ণনায় বিমান বিধ্বস্তের সেই মুহূর্ত

ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি দোতলা ভবনে গত সোমবার দুপুরে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়।

বিমানটি যখন আছড়ে পড়ে, তখন দোতলার একটি কক্ষে সাত-আটজন ছাত্রসহ আটকে পড়েন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির ইংরেজি বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক মোহাম্মদ সায়েদুল আমীন। পরে তিনি বারান্দার একটি ফটক ভেঙে ছাত্রদের অক্ষত বের করে আনেন।

মঙ্গলবার (২২ জুলাই) সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন এই শিক্ষক।

তিনি বলেন, স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। দোতলায় আমার সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে সাত-আটজন বাচ্চা ছিল। বেশির ভাগই অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। হঠাৎ বিকট শব্দ। প্রথমে ভেবেছি বজ্রপাতের শব্দ। কিন্তু আকাশ তো পরিষ্কার, সেটি তো হওয়ার কথা নয়। এরই মধ্যে পাশের নারকেলগাছে আগুন জ্বলতে দেখা গেল। কী ঘটেছে, ভাবতে ভাবতেই দোতলার বারান্দাসহ বিভিন্ন স্থানে আগুন ছড়াতে লাগল। ধোঁয়ায় দমবন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা।

সায়েদুল আমীন বলেন, আমি যে কক্ষটায় ছিলাম, সেটি ভবনের পশ্চিম দিকে। শেষ মাথায় ওয়াশরুম। কক্ষে টেকা কঠিন হয়ে পড়লে প্রথমে বাচ্চাদের নিয়ে ওয়াশরুমে আশ্রয় নিলাম। এর মধ্যে হঠাৎ মাথায় এল, এই পাশটায় বারান্দার শেষ মাথায় একটি ছোট লোহার পকেট গেট আছে। অবশ্য সেটি সব সময় তালা দেওয়া থাকে। সেদিনও তালা দেওয়া ছিল। তবে গেটের লোহা কিছুটা চিকন। ভাবলাম, দেয়াল তো আর ভাঙা যাবে না। গেটটা ভাঙতে পারলে বাঁচতে পারব। জীবন-মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে শেষ চেষ্টা আর কি! নিজের সন্তানের বয়সী ছাত্ররা ভয়, আতঙ্কে কুঁকড়ে গেছে। তাদের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না। শুধু বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিল।

তিনি বলেন, কীভাবে গেট ভাঙব, মাথায় আসছিল না। কয়েকটা লাথি দিয়েও কাজ হলো না। হঠাৎ দেখি বারান্দা দিয়ে দৌড়ে একটি ছেলে আমার দিকে আসছে। তার শার্টে আগুন। স্যার, আমাকে বাঁচান বলে আকুতি জানাল। আমি যখন তাকে ধরলাম, তখন আমার হাতও পুড়ে যাওয়ার জোগাড়। সময় ঘনিয়ে আসছিল। ততক্ষণে আগুন আর ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে পারছি না। আমি তখন ওয়াশরুমে থাকা ছেলেদের বললাম, গায়ে আগুন নিয়ে আসা ছেলেটিকে তোমরা পানি ঢালো। আমি এদিকে পকেট গেটটা ভাঙার চেষ্টা করি।

তিনি বলতে থাকেন, গেটটি ভাঙতে আমি ক্রমাগত লাথি মারতে থাকি। কতক্ষণ আর কত জোরে আমি লাথি দিয়েছি, তা এখন আর মনে নেই। শুধু ভাবছিলাম, যে করেই হোক গেটটা ভাঙতে হবে। একপর্যায়ে কয়েকটি চিকন লোহা ভেঙে এবং বাঁকা করে একটা শরীর ঢোকানোর মতো ফাঁকা করা গেল। গেটের লাগোয়া ছিল একটি আমগাছ। সেটা ধরে নিচে নামে দু-একজন। এর মধ্যে বাইরে থাকা লোকজন আমগাছে উঠে সবাইকে নামায়। বিকট শব্দ, ছাত্রদের ওয়াশরুমে নেওয়া, গেট ভাঙা— সব মিলিয়ে সম্ভবত মিনিট তিনেক সময়। এ সময়টুকুই তখন অনন্তকাল মনে হচ্ছিল।

সায়েদুল আমীন বলেন, নিচে নেমে প্রথমবার বুঝতে পারি যে আমাদের ভবনে বিমান আছড়ে পড়েছে। এর আগে বিমান দুর্ঘটনার কথা মাথাতেই আসেনি। আমার মনে হয়েছে, বিমানের যে ইঞ্জিনের শব্দ, সেটি ছিল না; বরং আছড়ে পড়ার পর দুবার বিকট শব্দ শুনেছি। প্রথমবার আছড়ে পড়ার। দ্বিতীয়বার মনে হয় জ্বালানির বিস্ফোরণ।

তিনি জানান, স্কুলের যে দোতলা ভবনে বিমানটি আছড়ে পড়ে, সেটির নিচতলায় বাংলা ভার্সনের ক্লাস হয়। দ্বিতীয় তলায় ইংরেজি মাধ্যমের। আমি যে তলায় ছিলাম, সেখানে সিঁড়ির দুই পাশে ১২টি কক্ষ। এক পাশে মেয়েদের শ্রেণিকক্ষ, অন্য পাশে ছেলেদের। এর বাইরে ল্যাবরেটরি, শিক্ষক কক্ষ আছে। বিমানটি আঘাত হানে ঠিক সিঁড়ির বরাবর, নিচতলায়। এরপর দ্রুত সর্বত্র আগুন ছড়ায়। বেলা একটার দিকে স্কুল ছুটি হয়েছে। রীতি অনুযায়ী, প্রথমে মেয়েরা নেমে যায়। এরপর ছেলেদেরও বেশির ভাগই নেমে গিয়েছিল। যেখানে বিমানটি আঘাত হানে, এর কাছাকাছি দ্বিতীয় তলায় একটি কক্ষে একজন শিক্ষক ও কয়েকজন ছাত্র ছিল। তাদের কক্ষে সবার আগে আগুন পৌঁছায়।

তিনি বলেন, আমি নিচে নেমে দেখলাম দুটি লাশ পড়ে আছে। তবে দেহ ছিন্নভিন্ন। নিজেকে সামলে রাখাই কঠিন হয়ে পড়ে। বাচ্চাদের অবস্থা কেমন, তা তো বোঝাই যায়। নিচে নামার পর নিচতলা থেকে দৌড়ে একটা মেয়েকে বের হতে দেখলাম। তার পরনে ছিল বোরকা, তাতে আগুন।

তিনি আরো বলেন, আমার সঙ্গে যে ছেলেগুলো ছিল, তাদের সবাই নিরাপদে বের হতে পেরেছে। তবে ধোঁয়া, আগুনের তাপে নিশ্বাসে সমস্যা হয়েছে। নামার সময় সামান্য আহত হতে পারে। শুনেছি, গায়ে আগুন নিয়ে যে ছেলেটি দৌড়ে এসেছিল, সে-ও বেঁচে আছে। হাসপাতালে ভর্তি।

জ্যেষ্ঠ এ শিক্ষক বলেন, বাচ্চারা পকেট গেট দিয়ে যখন বের হয়, তখন আগুন খুব কাছাকাছি। আমরা সাধারণত ৪০ ডিগ্রি বা এর বেশি তাপমাত্রা হলেও সাময়িক সময়ের জন্য সহ্য করতে পারি। কিন্তু সেখানে যে তাপমাত্র তৈরি হয়েছিল, তা সহ্যের বাইরে ছিল। এর সঙ্গে ধোঁয়া মিলে অসহনীয় অবস্থা। আর দু-এক মিনিট আটকে থাকলে হয়তো বেঁচে ফিরতে পারতাম না। বাচ্চাগুলোর কী হতো, তা ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। চোখের সামনে সন্তানতুল্য ছাত্রছাত্রীরা পুড়ে মারা গেছে। অনেকেই হাসপাতালের শয্যায় কাতরাচ্ছে। সহকর্মী শিক্ষকও মারা গেছেন। আহত হয়ে জীবন বাঁচাতে লড়ছেন অনেকে। এ এক বিভীষিকা। এমন দিন দেখতে হবে, তা কোনো দিন ভাবিনি। যে ফুলগুলো ঝরে গেছে, তাদের আমরা ফিরে পাব না। যারা বেঁচে আছে, তাদের যেন সৃষ্টিকর্তা ফিরিয়ে দেন— এই প্রার্থনাই করছি।

ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন