ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫

১০ আষাঢ় ১৪৩২, ২৭ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

শিরোনাম

Scroll
মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনাসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি ১ জুলাই
Scroll
মব জাস্টিস ঠেকাতে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা: ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী
Scroll
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হলো গুগলের ডিজিটাল পেমেন্ট সেবা ‘গুগল পে’
Scroll
ঠাকুরগাঁওয়ে বাস ও থ্রি-হুইলারের সংঘর্ষে বাবা এবং মেয়ে নিহত
Scroll
টানা প্রায় দুই সপ্তাহের সংঘাতের পর ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছে
Scroll
ইরান ও ইসরায়েল যুদ্ববিরতিতে সম্মত হয়েছে বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
Scroll
আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক লিওনেল মেসির জন্মদিন আজ

জাতীয় মাছ ইলিশ বর্ষাতেও নাগালের বাইরে

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ১৩:২৯, ২৩ জুন ২০২৫ | আপডেট: ১৮:৫৪, ২৩ জুন ২০২৫

জাতীয় মাছ ইলিশ বর্ষাতেও নাগালের বাইরে

ছবি: সংগৃহীত

রাজধানীর বাজারে এখন এক কেজি ওজনের একটি নদীর ইলিশের দাম চাওয়া হচ্ছে আড়াই হাজার টাকা; যা দেশের পোশাক শিল্পে কর্মরত একজন শ্রমিকের প্রায় ছয় দিনের নিম্নতম মজুরির সমান। গ্রীষ্মকালের মধ্যবিত্ত একটি পরিবারের মাসিক বিদ্যুৎ বিল বা দুই মাসের গ্যাস বিলের সমান খরচ করে কেবল একটি ইলিশ কিনতে হচ্ছে।

ছোট আকৃতির ইলিশের ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি ভিন্ন নয়। ৫০০ গ্রাম ওজনের নদীর (বিশেষত চাঁদপুর ও বরিশালের) ইলিশের প্রতি কেজির দাম দেড় হাজার টাকা, আর মাঝারি আকারের ৮০০ গ্রাম ওজনের এক কেজি ইলিশ কিনতে লাগছে প্রায় দুই হাজার টাকা। তুলনামূলকভাবে সাগরের ইলিশের দাম কিছুটা কম হলেও তা সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নয়।

বিক্রেতাদের দাবি, এখনো ইলিশের মৌসুম পুরোপুরি শুরু হয়নি, কিন্তু বাজারে ইলিশের উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। তবে যে দামে বিক্রি হচ্ছে, তা ভাবনার মধ্যে নয়। এটি কোনো সাম্প্রতিক প্রবণতা নয়; বরং বহু বছর ধরেই ইলিশের দাম চড়াই থাকছে।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, গত ১৯ জুন ঢাকার বাজারে এক কেজি ইলিশের দাম ছিল এক হাজার থেকে দুই হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত; যা আগের বছরের তুলনায় ৫৫ শতাংশ বেশি। একই সময়ে রুই ও তেলাপিয়ার দাম অপরিবর্তিত ছিল, আর কাতলা ও পাঙাশের দাম কমেছে। অর্থাৎ অন্য মাছের ঘাটতির কারণে ইলিশের দাম বাড়ছে— এমন যুক্তি টেকে না।

মৎস্যজীবী, গবেষক ও বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরবরাহ কমে যাওয়ায় এবং উচ্চ চাহিদার কারণে বিক্রেতারা বেশি দাম নেওয়ার সুযোগ নিচ্ছেন। ফলে জাতীয় মাছ ইলিশ আজ সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।

জানা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৭৩৫ প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত হয় ইলিশ। বিশ্বের মোট ইলিশের ৮০ শতাংশের বেশি উৎপাদন হয় বাংলাদেশে। মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষায় নানা কার্যক্রম নেওয়ার পর গত এক দশকে দেশের ইলিশ উৎপাদনে বড় অগ্রগতি হয়েছিল। ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো ইলিশ উৎপাদন পাঁচ লাখ মেট্রিক টন ছাড়ায়। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উৎপাদনে পতন ঘটছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদন ছিল পাঁচ লাখ ৭১ হাজার টন, আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ২৯ হাজার টনে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের হিসাব এখনো হয়নি, তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন এবারো উৎপাদন কমতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাষের মাছের উৎপাদনে ব্যয় বেশি, অথচ ইলিশের ক্ষেত্রে খরচ মূলত ধরা ও পরিবহনের পেছনে। বাজারে এক কেজি চাষের পাঙাশের দাম এখন ২০০ টাকার মতো, আর ইলিশের দাম তার ১০ গুণ। যদিও উৎপাদনে পাঙাশ (চার লাখ টন) ও তেলাপিয়া (চার লাখ ২১ হাজার টন) কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও, এ পরিসংখ্যান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

তারা জানান, ২০১৫ সালে খুচরা পর্যায়ে ইলিশের গড় দাম ছিল ৫৯০ টাকা; যা ২০২৩ সালে দাঁড়ায় এক হাজার ৩০ টাকা। ২০২৪ সালের হিসাব এখনো প্রকাশিত হয়নি, তবে বাজারের বাস্তবতা বলছে, দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

ইলিশের ভরা ক্ষেত্র চাঁদপুর। জেলাটির খুচরা বাজারেও চিত্র ভিন্ন নয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, চাঁদপুরে এক কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে আড়াই হাজার টাকায়। ৭০০-৮০০ গ্রাম ইলিশের কেজি এক হাজার ৭০০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

সরকার অতীতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করলেও বাস্তবে তা কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছে। বাজার বিশ্লেষকেরা মনে করেন, দাম নিয়ন্ত্রণে উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই। ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে হলে মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষার বিধিনিষেধ কঠোরভাবে কার্যকর করতে হবে।

ইলিশ গবেষকরা জানান, নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে না। আর উৎপাদন না বাড়লে জাতীয় মাছ ইলিশ সাধারণ মানুষের পাতে আর ফিরে আসবে না।

কারওয়ান বাজারে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মফিজুল ইসলাম বলেন, মাঝেমধ্যে সন্তানদের আবদারে ইলিশ কিনতে হয়। কিন্তু এখন যে দাম চাচ্ছে, তা কল্পনাও করা যায় না।

কারওয়ান বাজারের এক বিক্রেতা আলীৈ মিয়া জানান, তারা আড়তদারের কাছ থেকে বেশি দামে ইলিশ কিনতে বাধ্য হন, তাই কম দামে বিক্রির সুযোগ নেই। ইলিশের চাহিদা থাকলেও সরবরাহ বাড়েনি, ফলে দাম বেড়েছে।

চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসিন উদ্দিন বলেন, গোপন তদন্তে পেয়েছি ইলিশের দাম অকারণে বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আড়তদারেরা নিজেদের মধ্যে নিলামের মাধ্যমে দাম বাড়িয়ে নিচ্ছেন। এজন্য আমি সম্প্রতি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে ইলিশের দাম বেঁধে দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি।

চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শবে বরাত বলেন, একটি ছোট ট্রলার পাঁচ জন মাঝিমাল্লা নিয়ে তিন ঘণ্টায় মাত্র কয়েকটি ইলিশ ধরে, যা দিয়ে খরচই ওঠে না। এ কারণে দাম বেশি।

জাতীয় মৎস্যজীবী সমিতির মহাসচিব মো. ইকবাল হোসেন বলেন, গত দুই বছর নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে নজরদারির ঘাটতির কারণে মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষায় ব্যর্থতা দেখা গেছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে মা ইলিশ রক্ষার কার্যক্রম যখন শুরু হয়, তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল ছিল। এরপর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে’ আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। ওই সময় এবং তার পরপরই পুলিশি নজরদারি একপ্রকার অনুপস্থিত ছিল। ফলে মা ইলিশ রক্ষা, জাটকা সংরক্ষণ এবং অভয়াশ্রমে মাছ ধরা বন্ধ রাখার ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগে দুর্বলতা দেখা দেয়।

মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ শাখার সহকারী পরিচালক এম ফারুক ময়েদুজ্জামান বলেন, জনবল ও উপকরণের (যেমন নৌযান) অভাবে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি করা সম্ভব হয় না। এই ঘাটতির সুযোগে নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে। তিনি আরো বলেন, ইলিশের চলাচলের পথ (মাইগ্রেশন রুট) পরিবর্তন এবং প্রজননে ব্যাঘাত ঘটলেও উৎপাদন কমে যায়।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও ইলিশ গবেষক মো. আনিছুর রহমান বলেন, মে ও জুন মাস থেকে ইলিশ ধরা বাড়তে শুরু করে এবং সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ে। তিনি বলেন, জুনের দ্বিতীয় ভাগে ইলিশের দাম কেজিতে দুই হাজার ৫০০ টাকা হওয়া অস্বাভাবিক। অনেকেই তেলের ও জালের দাম বেড়েছে বলে যুক্তি দিলেও, ইলিশের এত চড়া দাম কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়।

ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ

আরও পড়ুন