ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৪ জুন ২০২৫

১০ আষাঢ় ১৪৩২, ২৭ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

নির্বাচনী প্রতীক

দাঁড়িপাল্লা ফিরছে, শাপলার কী হবে?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০:৪৮, ২৪ জুন ২০২৫

দাঁড়িপাল্লা ফিরছে, শাপলার কী হবে?

ছবি: সংগৃহীত

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনী প্রতীক তালিকা পুনর্বিন্যাসের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে এনেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কমিশন সূত্র জানায়, বর্তমান নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালায় (২০০৮) সংশোধন এনে নতুন করে প্রতীক তালিকা তৈরি করা হবে, যেখানে পুরোনো কিছু প্রতীক পুনরায় অন্তর্ভুক্তির পাশাপাশি অন্তত ৩১টি নতুন প্রতীক যুক্ত করা হতে পারে।

এই উদ্যোগের ফলে সম্প্রতি আদালতের আদেশে নিবন্ধন ফিরে পাওয়া বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ঐতিহাসিক প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ সংরক্ষিত প্রতীক তালিকায় ফিরে আসবে। পাশাপাশি নতুন দলগুলোর জন্য প্রতীক বরাদ্দ নিশ্চিত করতেও প্রয়োজনীয় প্রতীকের সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি।

বর্তমানে নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালায় দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য সংরক্ষিত প্রতীকের সংখ্যা ৬৯টি। তবে এবার দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যার প্রেক্ষিতে প্রতীকের সংখ্যা ১০০-র বেশি হতে পারে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ। তিনি বলেন, সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত প্রতীক চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে কমিশন খুব শিগগিরই বৈঠকে বসবে। সংশোধিত তালিকা প্রণয়নের কাজ চলমান।

২০১৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল হয় হাইকোর্টের রায়ে। এরপর ২০১৭ সালে এক ফুলকোর্ট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীকটি সংরক্ষিত তালিকা থেকে বাদ দেয়। তবে চলতি বছরের ১ জুন আদালতের আদেশে দলটি আবার নিবন্ধন পায় এবং ৪ জুন নির্বাচন কমিশনের সভায় জামায়াতকে ‘দাঁড়িপাল্লা’ প্রতীক ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

এদিকে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত হলেও তাদের ‘নৌকা’ প্রতীকটি তালিকায় থাকবে। কমিশনার রহমানেল মাছউদ বলেন, নিবন্ধন স্থগিত হলেও প্রতীক তালিকায় রাখার কোনো বাধা নেই।

বর্তমানে নির্বাচন কমিশনে ৫০টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত রয়েছে। তবে গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আরো কিছু দল নিবন্ধনের অনুমোদন পেতে পারে। রবিবার নিবন্ধনের আবেদন প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। এবার ১৪৭টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে, যা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। যাচাই-বাছাই শেষে যেসব দল সংবিধিবদ্ধ শর্ত পূরণ করবে, শুধু সেগুলোই নিবন্ধন পাবে।

নতুন দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ (এনসিপি) তাদের আবেদনপত্রে প্রতীক হিসেবে শাপলা, কলম ও মোবাইল ফোন চেয়েছে, তবে তাদের অগ্রাধিকার শাপলা প্রতীক। এই প্রতীকটি ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, কারণ শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘ফ্ল্যাগ অ্যান্ড এমব্লেম অর্ডার’ অনুসারে, শাপলা হচ্ছে দেশের জাতীয় প্রতীক। এটি কেবল দাপ্তরিক প্রয়োজনে ব্যবহারযোগ্য, অন্য কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন এটি ব্যবহার করতে পারে না।

অন্যদিকে, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম দাবি করেন, শুধু শাপলা নয়, ধানের শীষ, তারকাও জাতীয় প্রতীকের অন্তর্ভুক্ত। শাপলা প্রতীক ব্যবহারে আইনগত কোনো বাধা নেই। আমরা আশা করি, নির্বাচন কমিশন ন্যায্যতা বজায় রাখবে।

নির্বাচন কমিশনের সচিব আখতার আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, জাতীয় প্রতীক কেবল শাপলা নয়, আরও উপাদান রয়েছে। তবে শাপলা প্রতীক বরাদ্দের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন। নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ জানান, বিষয়টি এখনো কমিশনের বিবেচনায় রয়েছে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরেই সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে।

স্বাধীনতার পর থেকেই দলগুলোর নিজ নিজ নির্ধারিত প্রতীক ছিল। ২০০৮ সালে রাজনৈতিক দল নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করার পর, নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালায় প্রতীক তালিকা সংযুক্ত করা হয়। কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জেসমিন টুলী বলেন, নতুন দলগুলো সংরক্ষিত প্রতীক তালিকা থেকেই প্রতীক চাইবে। তালিকায় না থাকলে নির্বাচন পরিচালনা বিধিমালা সংশোধন করে নতুন প্রতীক যুক্ত করতে হয়।

ইতোমধ্যে ট্রাক, কেটলি, রকেট, মাথাল, ঈগল, ফুলকপি প্রতীক দেওয়া হলেও সেগুলো বিধিমালার সংরক্ষিত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সংশোধনের সময় এসব প্রতীক সংরক্ষিত তালিকায় যুক্ত করা হবে। দলীয় প্রার্থীদের ক্ষেত্রে প্রতীক নির্ধারিত থাকে, তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য একই প্রতীক একাধিক ব্যক্তি চাইলে লটারি করে প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতীক কেবল একটি চিহ্ন নয়, বরং তা দলীয় পরিচয়, আস্থা ও প্রচারণার মূল উপকরণ। ‘নৌকা’, ‘ধানের শীষ’, ‘লাঙ্গল’, ‘হাতি’, ‘তালা’– এসব প্রতীক জনমানসে গভীরভাবে প্রোথিত। নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতীক নির্ধারণও তাই হবে একটি স্পর্শকাতর ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া।

জাতীয় প্রতীকের ব্যবহার বিষয়ে আইন পরিষ্কার না থাকায় কমিশনকে হতে হবে সতর্ক। বিশেষ করে জাতীয় ফুল ‘শাপলা’র প্রতীক হিসেবে বরাদ্দ দেশের সাংবিধানিক কাঠামো ও প্রতীক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির স্থাপন করবে।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। নির্বাচনকালীন বিধিমালা ও প্রস্তাবিত সংশোধন দ্রুত চূড়ান্ত করতে হবে। কারণ দল নিবন্ধনের সঙ্গে সঙ্গেই প্রতীক নির্ধারণ করতে হবে, যাতে নির্বাচনী প্রস্তুতি যথাসময়ে শুরু করা যায়।

কমিশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী, সংশোধিত তালিকায় নতুন অন্তত ৩০-৩৫টি প্রতীক যুক্ত করে একটি পরিপূর্ণ ও সবার জন্য গ্রহণযোগ্য প্রতীক তালিকা চূড়ান্ত করা হবে। কমিশনের সচিব জানান, ইসি দলগুলোকে সমান সুযোগ দিতে চায়। কোনো দল যেন প্রতীক সংকটে না পড়ে, সেজন্য যথেষ্ট বিকল্প প্রতীক রাখার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ

আরও পড়ুন