ঢাকা, শুক্রবার, ০২ মে ২০২৫

১৮ বৈশাখ ১৪৩২, ০৩ জ্বিলকদ ১৪৪৬

ভারত-পাকিস্তান যত সংঘর্ষ ঘটেছে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ১৯:৫৩, ১ মে ২০২৫

ভারত-পাকিস্তান যত সংঘর্ষ ঘটেছে

পরিকল্পনা অনুযায়ী এগুলোর ঘোষণা দেওয়া হয় না এবং নিশ্চিতও করা হয় না। তবে বিগত দশকগুলোতে ভারত-পাকিস্তান একে অপরের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে একাধিক গোপন অভিযান চালিয়েছে। এসব অভিযানে সামরিক চৌকিগুলো লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে, সেনা হত্যা করা হয়েছে এবং মাঝে মাঝে শত্রুপক্ষের সেনাদের শিরশ্ছেদও করা হয়েছে।

এ ধরনের হামলা প্রায়শই প্রতিশোধ হিসেবে চালানো হয়। যখন কোনো সামরিক ইউনিট আক্রান্ত হয়, তখন সেখানকার কর্মীরা পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে এমন অভিযান চালান। তবে এ ধরনের অভিযান কখনোই নিশ্চিত করা হয় না। এর উদ্দেশ্য হলো অন্য দেশকে একটি বার্তা দেওয়া, কিন্তু এমন পরিস্থিতি তৈরি না করা, যাতে তারা পাল্টা জবাব দিতে বাধ্য হয়। এর ফলে সংঘাত বৃদ্ধির ঝুঁকি কমানো যায়। জনসমক্ষে ঘোষণা দিলে সরকারের ওপর পাল্টা আঘাত হানার জন্য অভ্যন্তরীণ চাপ সৃষ্টি হয়।

সার্জিক্যাল স্ট্রাইক

মাঝে মাঝে অবশ্য উদ্দেশ্য থাকে সূক্ষ্ম বার্তা দেওয়া নয়, বরং অন্য দেশকে বিব্রত করা। হামলা জনসমক্ষে প্রকাশ করে এটি করা হয়। রাজনৈতিকভাবেও এটি লাভজনক হয়। ভারত অতীতে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে তথাকথিত সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে সাম্প্রতিক ছিল ২০১৬ সালের হামলা।

তখন উরিতে এক হামলায় ১৭ জন ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পর ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিশেষ বাহিনী সীমান্ত পেরিয়ে হামলা চালায়। নয়াদিল্লি অভিযোগ করেছিল, যেখানে হামলা চালানো হয়েছে, সেগুলো ছিল ‘লঞ্চ প্যাড।’ সেখান থেকে ‘সন্ত্রাসীরা’ ভারতে আবার হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছিল।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর তৎকালীন ডিরেক্টর জেনারেল অব মিলিটারি অপারেশনস লেফটেন্যান্ট জেনারেল রণবীর সিং এক বিবৃতিতে এই অভিযানের কথা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘এসব অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিল নিশ্চিত করা যে, এই সন্ত্রাসীরা অনুপ্রবেশ এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আমাদের দেশের নাগরিকদের জীবন বিপন্ন করার তাদের পরিকল্পনায় সফল না হয়।’ ভারত দাবি করেছিল যে, এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে কয়েক ডজন যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। যদিও স্বাধীন বিশ্লেষকদের মতে নিহতের সংখ্যা সম্ভবত এর চেয়ে অনেক কম ছিল।

আকাশপথে হামলা

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় এক আত্মঘাতী হামলায় ৪০ ভারতীয় আধাসামরিক সেনা নিহত হন। ভারতের জাতীয় নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে এই ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী জইশ-ই-মুহাম্মদ এই হামলার দায় স্বীকার করে।

এতে ভারতে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে বিমান হামলা চালায়। ভারত দাবি করে, তারা সেখানে ‘সন্ত্রাসীদের’ আস্তানা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে এবং কয়েক ডজন জঙ্গিকে হত্যা করেছে।

তবে পাকিস্তান জোর দিয়েছিল যে, ভারতীয় বিমান শুধু একটি বনাঞ্চলে আঘাত হেনেছে এবং কোনো জঙ্গিকে হত্যা করেনি। ইসলামাবাদ পাল্টা দাবি করে, তাদের যুদ্ধবিমান ভারতীয় বিমানগুলোকে তাড়িয়ে নিয়ন্ত্রণরেখার ওপারে ফেরত পাঠিয়েছে।

কিন্তু এর এক দিন পরেই ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধবিমানগুলো আবারও আকাশযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এবার পাকিস্তান তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকায় একটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করে। ভারতীয় বিমানবাহিনীর এক পাইলটকে আটক করে পাকিস্তান এবং কয়েক দিন পর তাঁকে ফেরত পাঠানো হয়।

পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত ভূমি দখলের চেষ্টা

গত কয়েক বছর ধরে ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর ফিরিয়ে নেওয়ার দাবি জোরালো হচ্ছে। সম্প্রতি পেহেলগাম হামলার পর এই দাবি আরও তীব্র হয়েছে। এমনকি বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতারাও মোদি সরকারকে ওই ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারে চাপ দিচ্ছেন।

পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর পুনরুদ্ধার করা ভারতের প্রতিটি সরকারের নীতিগত লক্ষ্য। তবে দুই দেশের প্রায় সমশক্তির সামরিক সক্ষমতার কারণে এমন প্রচেষ্টা সফল হওয়া কঠিন। তবে পাকিস্তানের কাছ থেকে বিতর্কিত অঞ্চল দখলের ক্ষেত্রে ভারতের সাফল্য রয়েছে।

১৯৮৪ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং ভারতীয় বিমানবাহিনী ‘অপারেশন মেঘদূত’ শুরু করে। এর মাধ্যমে তারা দ্রুত হিমালয়ের সিয়াচেন হিমবাহ দখল করে নেয়। এটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ গিরিপথগুলোতে প্রবেশ বন্ধ করে দেয়। বিশ্বের বৃহত্তম অমেরু হিমবাহগুলোর মধ্যে অন্যতম এই সিয়াচেন। তখন থেকে এটি পৃথিবীর উচ্চতম যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এখানে ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক ঘাঁটিগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।  

নৌপথে হামলা

পেহেলগামে হামলার পর ভারতীয় নৌবাহিনী ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার কথা ঘোষণা করে। গত ২৭ এপ্রিল নৌবাহিনী এক বিবৃতিতে জানায়, ‘ভারতীয় নৌবাহিনীর জাহাজগুলো সফলভাবে একাধিক জাহাজ-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। এর মাধ্যমে দূরপাল্লার নিখুঁত আক্রমণাত্মক সক্ষমতা এবং প্ল্যাটফর্ম, সিস্টেম ও ক্রুদের প্রস্তুতি পুনরায় যাচাই ও প্রদর্শন করা হয়েছে।’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘ভারতীয় নৌবাহিনী যেকোনো সময়, যেকোনো স্থানে, যেকোনো পরিস্থিতিতে জাতির সামুদ্রিক স্বার্থ রক্ষায় যুদ্ধে প্রস্তুত, বিশ্বাসযোগ্য এবং ভবিষ্যৎমুখী অবস্থানে রয়েছে।’

পূর্ণাঙ্গ সামরিক সংঘাত

ভারত ও পাকিস্তান তাদের স্বাধীনতার ৭৮ বছরে চারবার যুদ্ধে জড়িয়েছে। এর মধ্যে তিনটি যুদ্ধই হয়েছে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে। ১৯৪৭ সালের আগস্টে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার ভারতীয় উপমহাদেশকে ভাগ করে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টি করে চলে যাওয়ার দুই মাস পর দুই প্রতিবেশী কাশ্মীর নিয়ে প্রথম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। তখন কাশ্মীর একজন রাজার শাসনাধীন ছিল।

পাকিস্তানি মিলিশিয়ারা কাশ্মীর দখল করার চেষ্টা করে আক্রমণ চালায়। রাজা হরি সিং ভারতের কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। দিল্লি সাহায্যের জন্য রাজি হয়, কিন্তু একটি শর্তে। শর্তটি ছিল যে, সিংকে একটি ‘অ্যাকসেশন চুক্তিতে’ স্বাক্ষর করতে হবে, যার মাধ্যমে কাশ্মীর ভারতের সঙ্গে যুক্ত হবে। রাজা এতে সম্মত হন। এরপর, ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি যুদ্ধ শেষ হয় যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে। সেই থেকে ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মীরের অংশবিশেষ নিজেদের দখলে রেখেছে।

এরপর, ১৯৬৫ সালে দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে সংঘর্ষ পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নেয়। পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধবিরতি রেখা অতিক্রম করে ভারত-শাসিত কাশ্মীরে প্রবেশ করে। অন্যদিকে, ভারতীয় বাহিনী আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানের লাহোরে প্রবেশ করে এবং হামলা চালায়। উভয় পক্ষে হাজার হাজার হতাহতের পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রস্তাবের মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ হয়।

এরপর তৃতীয় দফায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ও ভারত সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতায় সহায়তা করে। ১৯৭২ সালে দুই দেশ সিমলা চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা নিয়ন্ত্রণরেখা বা এলওসি নির্ধারণ করে।

সর্বশেষ, ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রণরেখা অতিক্রম করে কারগিল যুদ্ধের সূচনা করে। লাদাখ অঞ্চলের বরফ ঢাকা উচ্চভূমিতে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানি সৈন্যদের পিছু হটতে বাধ্য করে।

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন