ঢাকা, শুক্রবার, ০২ মে ২০২৫

১৮ বৈশাখ ১৪৩২, ০৩ জ্বিলকদ ১৪৪৬

নরকেও প্রেমে পড়া যাবে, এখানে নয়

ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে মায়ের সঙ্গে নয় মাসের শিশুর বিচ্ছেদ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ২১:৫৮, ১ মে ২০২৫ | আপডেট: ২২:৫৬, ১ মে ২০২৫

ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে মায়ের সঙ্গে নয় মাসের শিশুর বিচ্ছেদ

মুহূর্তটা ছিল বিদায়ের। তপ্ত রোদের মধ্যে শক্ত করে স্বামী ফারহানের হাত ধরে রেখেছিলেন সায়রা। মন চাচ্ছে ফারহানের হাতে আরও কিছুক্ষণ থাকুক সায়রার হাত।কাঁটাতার আর ব্যারিকেডে ঘেরা এক চেকপয়েন্টে অপেক্ষায় এ দম্পতি, দুজনের পরিচয়ের একমাত্র চিহ্ন পাসপোর্টের রং-সায়রার সবুজ, ফারহানের নীল।

সীমান্তটা অনেকেরই পরিচিত, একদিকে ভারতের আত্তারি গ্রাম, অন্যদিকে পাকিস্তানের ওয়াঘা। সেখানেই এসে মিলেছে ভারত ও পাকিস্তানের প্রধান সীমান্ত চেকপোস্ট। কিন্তু দুই দেশের মানুষের ঘটছে বিচ্ছেদ। এই সীমান্ত পথ বহু বছর ধরে ভারত ও পাকিস্তানের নাগরিকদের জন্য ভ্রমণের একটি গেটওয়ে ছিল। তবে আজ সেই আত্তারি-ওয়াঘা সীমান্ত বিভাজনের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ভারত ও পাকিস্তানের চলমান উত্তেজনার মধ্যে দুই দেশ তাদের নাগরিকদের সীমান্তের ওপারের যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করছে। হাজারো পরিবারের ওপর এর প্রভাব পড়ছে, যাদের কিছু সদস্য ভারতের, আবার কিছু সদস্য পাকিস্তানের।

ভারত সরকার গত মঙ্গলবারের মধ্যে প্রায় সব পাকিস্তানি নাগরিককে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেওয়ার পর ৯ মাসের ছেলে আজলানকে নিয়ে সায়রা ও ফারহান নয়াদিল্লি থেকে সারা রাত ভ্রমণ করে সীমান্ত ক্রসিংয়ে পৌঁছান। ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীর হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই নির্দেশ দেওয়া হয়। 

সায়রার দিকে তাকিয়ে ফারহান বলেন, ‘শিগগিরই আমাদের দেখা হবে।’ এরপর শিশুপুত্র আজলানের গালে চুমু খেয়ে বিদায় জানালেন ফারহান। বলেন, ‘ইনশা আল্লাহ, খুব শিগগির দেখা হবে। আমি তোমাদের দুজনের জন্য দোয়া করব।’
তিন বছর আগে ফেসবুকের মাধ্যমের পাকিস্তানের করাচির বাসিন্দা সায়রার সঙ্গে নয়াদিল্লির ফারহানের প্রেম হয়। এরপর বিয়ে। সায়রা চলে আসেন নয়াদিল্লিতে। তবে গত মঙ্গলবার আত্তারি সীমান্তে দাঁড়িয়ে সায়রা ও ফারহান যখন একে অপরের দিকে তাকাচ্ছিলেন, তখন দুজনেরই চোখ ভিজে উঠেছিল। সেই মুহূর্তে এক সীমান্তরক্ষী তাঁদের তাড়া দিয়ে বললেন-‘চলুন, সময় নেই।’

সায়রার দিকে তাকিয়ে ফারহান বলেন, ‘শিগগিরই আমাদের দেখা হবে।’ এরপর শিশুপুত্র আজলানের গালে চুমু খেয়ে বিদায় জানালেন ফারহান। বললেন, ‘ইনশা আল্লাহ, খুব শিগগির দেখা হবে। আমি তোমাদের দুজনের জন্য দোয়া করব।’ ঠিক তখনই এক নিরাপত্তারক্ষী এগিয়ে এসে আজলানের পাসপোর্টের দিকে ইশারা করলেন। সেটি ছিল নীল রঙের-মানে ভারতীয়।নিরাপত্তারক্ষী সায়রাকে বললেন, ‘বাচ্চাটি যাবে না, ম্যাডাম।’ সায়রা তখনো বাঁ হাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আছেন। এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওই দম্পতিকে আলাদা করে দেওয়া হয়। এরপর সায়রা চললেন করাচির পথে, আর ফারহান তাঁদের দুধের সন্তান আজলানকে নিয়ে ফিরে গেলেন নয়াদিল্লিতে।

ফারহান বলেন, ‘সীমান্ত পার হওয়ার সময় ও (সায়রা) অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। কর্মকর্তারা আমাকে বললেন, ও জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর কান্না থামাতে পারছিল না।’ ফারহানের পুরো পরিবার ঘরের প্রিয় সায়রাকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন। সকলের চোখ ছিল অশ্রুসজল। হিন্দিতে আয়েশা বলেন, ‘ইয়ে সব পেয়ার কে মরে হ্যায় (এরা সব প্রেমের বলি)।’ ভারত-পাকিস্তান টানাপোড়েনে একেকটি পরিবারকে ছিন্নভিন্ন হতে দেখা আয়েশা বেগমের উপলব্ধি, ‘নরকেও প্রেমে পড়া যাবে, কিন্তু কখনো এখানে নয়।’ 

২২ এপ্রিলের হত্যাকাণ্ডের পর এ পর্যন্ত আনুমানিক ৭৫০ জন পাকিস্তানি পাসপোর্টধারী সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে ফিরে গেছেন। আর পাকিস্তান থেকে ভারতে ফিরেছেন প্রায় ১ হাজার ভারতীয় নাগরিক।

এ সিদ্ধান্তের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মানুষদের মধ্যে আছেন দুই দশক পর ভারতে মায়ের বাড়িতে বেড়াতে আসা পাকিস্তানি নারী, ভারতে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আসা দুই বোন-যাঁদের অনুষ্ঠানে যোগ না দিয়েই ফিরতে হয়েছে এবং ভারতে চিকিৎসা নিতে আসা বয়স্ক পাকিস্তানি রোগীরাও।

৪৮ বছর বয়সী হালিমা বেগমও এ তালিকায় আছেন। ওডিশা থেকে দুই দিন ধরে দুই হাজার কিলোমিটারের বেশি পথ (প্রায় ১ হাজার ২৫০ মাইল) পাড়ি দিয়ে আত্তারি সীমান্তে পৌঁছেছেন তিনি।

হালিমা বেগম ২৫ বছর আগে করাচি ছাড়েন। সেই সময় ওডিশার এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। জীবন মোটামুটি ভালোই চলছিল। এর মধ্যেই সম্প্রতি এক পুলিশ কর্মকর্তা এসে তাঁর হাতে ভারত সরকারের ‘ভারত ছাড়ো’ নোটিশ ধরিয়ে দিয়েছেন।

সীমান্তের কাছে একটি ট্যাক্সিতে বেশ কিছু ব্যাগ নিয়ে বসে ছিলেন হালিমা। তিনি বলেন, ‘আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি ওনাদের বলেছিলাম, আমি তো এখানে এমনি এমনি আসিনি—আমার বিয়ে হয়েছে ভারতে। ভারত সরকার যে আমার এত বছরের গড়ে তোলা জীবনকে এক ঝটকায় ছিঁড়ে ফেলছে এবং আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে, তা কি ন্যায্য হচ্ছে?’

২৫ বছর ভারতে কাটানো হালিমা বলেন, দেশটা তাঁরও দেশ হয়ে গেছে। হালিমার সঙ্গে ছিলেন তাঁর দুই ছেলে-২২ বছর বয়সী মুসাইব আহমেদ ও ১৬ বছরের যুবায়ের আহমেদ। আট বছর আগে তাঁদের বাবা মারা গেছেন। দুই ভাই মিলে ঠিক করেছেন, যুবায়ের মায়ের সঙ্গে সীমান্ত পার হবে, যেন সে মায়ের দেখাশোনা করতে পারে।

দুই ছেলের পাসপোর্টই নীল (ভারতীয়)। আর হালিমার পাসপোর্ট সবুজ (পাকিস্তানি)। মুসাইব ও যুবায়ের শুরুতে সীমান্তরক্ষীদের কাছে কাকুতি-মিনতি করেছিলেন, এমনকি শেষে তর্কেও জড়ান। কিন্তু কোনো কিছুতে কাজ হয়নি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মুসাইব বলেন, ‘মা কখনো একা কোথাও যাননি। আমি জানি না, উনি কীভাবে এই ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে করাচি পৌঁছাবেন।’

করাচিতে হালিমার যাওয়ার মতো কোনো ঘর নেই। তাঁর মা–বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। তাঁর একমাত্র ভাই নিজের ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে মাত্র দুটি কক্ষে থাকেন।

চোখ মুছতে মুছতে হালিমা বলেন, ‘হাজারটা প্রশ্ন ঘুরছে মাথায়। কিন্তু একটারও উত্তর নেই।’

সায়রা ও ফারহানের মতো করে বিগত কয়েক দশকে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের টানাপোড়েনে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বহু পরিবার এ আশায় বুক বেঁধে থেকেছে যে অচিরেই তারা আবার মিলিত হবে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবে তা ঘটেনি।

 

ঢাকা এক্সপ্রেস/ এমআরএইচ 

আরও পড়ুন