ঢাকা, বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫

৪ আষাঢ় ১৪৩২, ২১ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

ইরানে যেভাবে শিয়াদের রাজত্ব তৈরি হলো

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ১৭:০৮, ১৭ জুন ২০২৫

ইরানে যেভাবে শিয়াদের রাজত্ব তৈরি হলো

আজকের ইরানকে আমরা জানি একটি শিয়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হিসেবে। বিশ্বজুড়ে শিয়াদের প্রতিনিধিত্বকারী দেশ হিসেবেও পরিচিত ইরান। কিন্তু ইতিহাসের এক পর্যায়ে এই ভূখণ্ড ছিল সুন্নি মুসলমানদের দ্বারা অধিকৃত। তাহলে কীভাবে একটি গোটা জাতি এত বড় ধর্মীয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেল? এর পেছনে রয়েছে এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কাহিনি—যা শুধু ইতিহাস নয়, বরং বর্তমান মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতিতেও গভীর ছাপ ফেলেছে।

শিয়া মতবাদের জন্ম: আলীর অনুসারীদের আন্দোলন

ইসলামের ইতিহাসে শিয়া মতবাদের উত্থান ঘটে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)–এর ওফাতের পর। তখন মুসলিম উম্মাহর মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। এক পক্ষ বিশ্বাস করতেন, নবীজির ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ও জামাতা হযরত আলী (রা.)–ই মুসলিম উম্মাহর প্রকৃত নেতা হওয়ার যোগ্য। এই বিশ্বাস থেকে জন্ম নেয় "শিয়াতে আলী" অর্থাৎ "আলীর অনুসারী" গোষ্ঠী, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘শিয়া’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। শিয়াদের মতে, হযরত আলী ও তাঁর বংশধরদের মধ্যেই ইসলামি নেতৃত্ব সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। এই দৃষ্টিভঙ্গির ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে দ্বাদশী শিয়া মতবাদ, যার অনুসারীরা ১২ জন ইমামকে ইসলামের প্রকৃত উত্তরাধিকারী মনে করেন।

সুন্নি থেকে শিয়ায় রূপান্তর: সাফাভি সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত

১৫০১ সাল ছিল ইরানের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ওই বছর ককেশাস অঞ্চল থেকে আগত এক তরুণ শাসক শাহ ইসমাইল প্রথম ইরানে সাফাভি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। নিজের পরিচয়ে শুধু রাজা নন, বরং আধ্যাত্মিক নেতা ও হযরত আলীর বংশধর বলে দাবি করেন তিনি। তাঁর লক্ষ্য ছিল একটি স্বতন্ত্র, ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী ইরানি জাতি গড়ে তোলা—যা প্রতিবেশী সুন্নি অটোমান সাম্রাজ্য থেকে ভিন্ন হবে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উভয় বিচারে। এই উদ্দেশ্যেই শাহ ইসমাইল দ্বাদশী শিয়া ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন। এ ছিল এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত, যা কেবল একটি শাসকগোষ্ঠী নয়, বরং গোটা জাতির ধর্মীয় পরিচয় আমূল বদলে দেয়।

রূপান্তরের পেছনের বাস্তবতা: আদর্শ না চাপিয়ে দেওয়া?

ধর্মীয় রূপান্তরটি ছিল মোটেও শান্তিপূর্ণ নয়। ইতিহাসবিদরা জানান, ইরানের বিভিন্ন অঞ্চলে জোরপূর্বক শিয়া ধর্মে দীক্ষিত করা হয় স্থানীয় সুন্নি জনগণকে। বিশেষ করে জনবিরল ও প্রতিরোধকারী এলাকাগুলোতে ব্যাপক দমন-পীড়নের ঘটনা ঘটে। একইসঙ্গে শাহ ইসমাইল লেবানন, ইরাক, বাহরাইন প্রভৃতি এলাকা থেকে শিয়া আলেম, সুফি ও কবিদের ইরানে আমন্ত্রণ জানান। তাঁরা ইরানে ধর্মীয় শিক্ষা, সাহিত্য, আইন এবং সংস্কৃতির মাধ্যমে ধীরে ধীরে শিয়া মতবাদের ভিত্তি মজবুত করেন।

স্থায়ী প্রভাব: আজকের ইরান

সেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের প্রতিফলন আজও দৃশ্যমান। বর্তমানে ইরানের প্রায় ৯০–৯৫ শতাংশ নাগরিক শিয়া মুসলমান। যদিও তারা দ্বাদশী শিয়া মতবাদ অনুসরণ করেন, তবুও নিজেদের সর্বপ্রথম মুসলমান হিসেবেই পরিচয় দিতে ভালোবাসেন এবং অন্যান্য মুসলমানদের সঙ্গে একত্রে অবস্থান করতে আগ্রহী।

ধর্ম থেকে রাষ্ট্রীয় পরিচয় পর্যন্ত

এই রূপান্তর কেবল ধর্মীয় ছিল না—এটি ইরানের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার কৌশলও ছিল। শিয়া মতবাদ গ্রহণ করে ইরান একদিকে নিজেকে অটোমান সাম্রাজ্য থেকে আলাদা করেছিল, অন্যদিকে গড়ে তুলেছিল নিজস্ব ধর্মীয় নেতৃত্ব কাঠামো ও সংস্কৃতি। এই ধর্মীয় পরিচয় পরবর্তীকালে ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, বিপ্লব, এমনকি আজকের পররাষ্ট্রনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলেছে।

ইরানের শিয়া পরিচয়ের ইতিহাস একটি জাতির নিজস্বতা গড়ার সংগ্রামের প্রতিফলন। ধর্ম, রাজনীতি ও সংস্কৃতির মেলবন্ধনে ইরান আজ যে অবস্থানে, তার শিকড় লুকিয়ে রয়েছে পাঁচ শতাব্দী আগের এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তে। ইতিহাসের এমন অধ্যায় জানলে বোঝা যায়—কখনো কখনো গোটা জাতির ধর্মীয় রূপরেখাও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বদলে যেতে পারে।

ঢাকা এক্সপ্রেস/ এমআরএইচ

আরও পড়ুন