ঢাকা, বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫

৪ আষাঢ় ১৪৩২, ২১ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের ছায়া ফিরে আসছে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ১৬:৪৫, ১৮ জুন ২০২৫

২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের ছায়া ফিরে আসছে

ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সামরিক সংঘাত ঘিরে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়বে কি না, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে জোর আলোচনার ঢেউ। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, ২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি ইরানের বিরুদ্ধে তার অবস্থান আরও কঠোর করেছেন। তিনি এখন শুধু ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের দাবিই করছেন না, বরং ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কার্যক্রম এবং মধ্যপ্রাচ্যে মিত্রদের সহায়তাও পুরোপুরি বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছেন। আরও একধাপ এগিয়ে নেতানিয়াহু প্রকাশ্যে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন এবং ইরানিদের সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোরও আহ্বান জানিয়েছেন।

সরকার পতনের কৌশল?

মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, নেতানিয়াহুর এই বক্তব্য ইরানে সরকার পরিবর্তনের কৌশল হিসেবেই দেখা হচ্ছে। কুইন্সি ইনস্টিটিউটের গবেষক আনেল রদ্রিগেজ শেলাইন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া ইসরায়েল একা ইরানি সরকারকে এতটা দুর্বল করতে পারবে না যে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে।’ তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, ইসরায়েল এবং তাদের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মিত্ররা প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ নিতে উসকানি দিচ্ছে—যেমনটা হয়েছিল ২০০৩ সালে ইরাকের ক্ষেত্রেও।

তৎকালীন ইরাক যুদ্ধের মতোই এবারও পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি সংক্রান্ত বিতর্ক সামনে আসছে। যদিও মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড বলেছেন, ইরান এখনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে নেই, তবু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মঙ্গলবার ইঙ্গিত দেন, ‘তারা খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।’

অভ্যন্তরীণ ঐক্যে ইরান

ইসরায়েল ১৪ জুন থেকে ইরানে বড় আকারে হামলা শুরু করার পর দেশটির অভ্যন্তরে এক ধরনের জাতীয় ঐক্য তৈরি হয়েছে। সরকারের বিরোধীরা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষও এখন সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে। স্টিমসন সেন্টারের বিশ্লেষক বারবারা স্লাভিন বলেন, ‘অনেক ইরানি সরকার পরিবর্তন চান, কিন্তু সেটা যেন বাইরের কোনো দেশের হস্তক্ষেপে না হয়—এটা তাঁদের স্পষ্ট বার্তা।’

স্লাভিন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ইসরায়েল কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে টেনে আনার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমরা জানি, একবার যুদ্ধ শুরু হলে তা থামানো সহজ হয় না।’

যুদ্ধের প্রচারণা নাকি বাস্তব হুমকি?

অনেক বিশ্লেষক নেতানিয়াহুর কড়া কথাগুলোকে যুদ্ধকালীন প্রচারণা হিসেবেই দেখছেন। আরব গালফ স্টেটস ইনস্টিটিউটের গবেষক হুসেইন ইবিশ বলেন, ‘এগুলো আসলে বাইরের বিশ্বের উদ্দেশ্যে পাঠানো বার্তা।’

ইউরোপের প্রতিক্রিয়াও মিশ্র। জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ ম্যার্ৎস বলেন, ইসরায়েল পশ্চিমা মিত্রদের হয়ে ‘নোংরা কাজটি’ করছে, কিন্তু স্বীকার করেন যে, ইরানের সবচেয়ে সুরক্ষিত পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালানোর মতো সামর্থ্য ইসরায়েলের নেই। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘যুদ্ধের মাধ্যমে সরকার বদলানোর চেষ্টাই সবচেয়ে বড় ভুল। ইরাক ও লিবিয়ায় আমরা তার ফল দেখেছি।’

ইরান প্রস্তুত, তবে সতর্ক

যুদ্ধের সম্ভাবনা যতই বাড়ুক, ইরান এখনো পূর্ণ সামরিক শক্তি ব্যবহার করছে না বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। ইসরায়েল দিনের বেলা আকাশ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালালেও, ইরান রাতের অন্ধকারে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে পাল্টা হামলা করছে। তবে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে হামলার পরিমাণ কিছুটা কমেছে।

জাতিসংঘের নিরস্ত্রীকরণ ইনস্টিটিউটের গবেষক আবদুলরসুল দিবসাল্লার জানান, ইরানের বেশির ভাগ ক্ষেপণাস্ত্র গোপন সুড়ঙ্গগুলোতে মজুত রয়েছে, যেগুলো এখনো আঘাতপ্রাপ্ত হয়নি। তার ভাষায়, ‘এই বাস্তবতা ইঙ্গিত দেয়, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র বাহিনী এখনো অক্ষত এবং প্রয়োজনে তা দ্রুত ব্যবহারযোগ্য করা সম্ভব।’

মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে ভয়

যুক্তরাষ্ট্র যদি সরাসরি এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে আরব উপসাগরীয় দেশগুলোর ওপরও বড় ধরনের হুমকি আসবে। কারণ, ইরান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা ঘাঁটি লক্ষ্যবস্তু হবে। শেলাইন বলেন, ‘যুদ্ধ হলে আরব দেশগুলোর অর্থনৈতিক রূপান্তরের পরিকল্পনাগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

স্টিমসন সেন্টারের স্লাভিন মনে করেন, ‘আরব দেশগুলো ইরানকে হয়তো ভালোবাসে না, কিন্তু তারা চাইছে না ইসরায়েল নতুন আঞ্চলিক কর্তৃত্বে পরিণত হোক।’ তাঁর মতে, যুদ্ধ শুরু হলে শুধু ফিলিস্তিন ইস্যু নয়, বিনিয়োগ, পর্যটন ও নতুন শিল্প খাতও ধ্বংস হয়ে যাবে।

সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যকার ২০২৩ সালের সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের চুক্তি এখন প্রশ্নবিদ্ধ। চীনের মধ্যস্থতায় গড়ে ওঠা সেই কৌশল আজ বড় ধরনের পরীক্ষার মুখে।

ঢাকা এক্সপ্রেস/ এমআরএইচ

আরও পড়ুন