ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫

৫ আষাঢ় ১৪৩২, ২২ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৬

‘গোছানো ঘর’র শেষ ছবি তুলে বিদায় নিচ্ছেন ইরানিরা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫:৩৬, ১৯ জুন ২০২৫

‘গোছানো ঘর’র শেষ ছবি তুলে বিদায় নিচ্ছেন ইরানিরা

একটা খালি সোফা। সামনে রাখা সুটকেসে গুছিয়ে রাখা কিছু দরকারি জিনিস। জানালায় পর্দা টানা। পাশে টবভর্তি ঘরোয়া গাছ, আর যত্ন করে সাজানো কুশন। সবকিছু এতটাই নিখুঁতভাবে গুছানো যেন কেউ ছুটি কাটাতে যাচ্ছে—আসবে ফিরে। অথচ ছবির শিরোনামটা অন্য কথা বলে—‘দ্য লাস্ট ফটো অফ হোম’।

এই ক্যাপশনেই ইরানের সামাজিক মাধ্যমে ঝড় তুলেছেন তেহরানসহ নানা শহরের মানুষ। ইসরায়েলি বোমাবর্ষণের ছায়ায় নিজেদের ঘর ফেলে পালিয়ে যাওয়ার আগে, তারা ছবি তুলছেন, স্মৃতি ধরে রাখছেন—শেষবারের মতো।

ইনস্টাগ্রামে একজন লিখেছেন, ‘প্রিয়জনদের উপহার আর প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নিলাম। গাছগুলোতে পানি দিলাম। তারপর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। জানি না, কোনোদিন ফিরে এসে এই ঘরটা পাব কি না।’

আরেকজনের ক্যাপশনে গভীর হাহাকার—‘কখনো এতটা কষ্ট হয়নি। এত যত্ন করে সাজানো নিজের আশ্রয়টা এক মুহূর্তে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে হৃদয়ের এক টুকরো ফেলে যাচ্ছি এখানে।’

কেউ শেয়ার করছেন তার কাজের ডেস্ক, ল্যাপটপ, হেডফোনের ছবি। লিখেছেন, “যেগুলো পেতে মাথার চুল সাদা হয়ে গেছে, রাতের পর রাত ঘুমহীন কেটেছে—আজ সেই জিনিসগুলোর কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। ফিরতে পারব তো?”

তেহরান শহরের এক তরুণ লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছিলাম, স্বপ্ন ছিল বড় হওয়ার। এখন শহর ছেড়ে যাচ্ছি, অথচ জানি না আদৌ ফিরতে পারব কি না।’

প্রায় এক কোটি মানুষের শহর তেহরানে এখন আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার ছায়া। যানজটে ভরা রাস্তায় পালিয়ে যাওয়া মানুষের ঢল। পেট্রল পাম্পে দীর্ঘ সারি। কিন্তু তেহরানের আকাশে যখন ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান গর্জন করে, তখন এসব অপেক্ষাও ছোট হয়ে যায়।

তবে সবাই তো আর চলে যেতে পারছেন না। কারও আছে অসুস্থ বাবা-মা, কারও আছে ছোট সন্তান। এক গর্ভবতী নারী বললেন, ‘এই যানজটে আমি বাঁচতে পারব? আমার সবকিছু এখানে, আমি কোথায় যাব?’

অন্য একজন নারী বললেন, ‘আমার গাড়ি আছে, কিন্তু তেহরান থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূরে পরিবারের কাছে যাওয়ার সাহস নেই। যদি রাস্তায় জ্বালানি না পাই? যদি গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়?’

আর এক মা, যিনি তার দুই সন্তানকে নিয়ে রয়েছেন তেহরানে, বললেন—‘যদি সব ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে আমিও সন্তানদের নিয়ে এই বাড়িতেই শেষ হয়ে যাব। আবার নতুন করে সবকিছু শুরু করার শক্তি আমার আর নেই।’

বিদেশে থাকা লাখো ইরানিও দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেও হোঁচট খাচ্ছেন—ইন্টারনেট বারবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।

একজন প্রবাসী ইনস্টাগ্রামে লিখেছেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম, অভিবাসনের সবচেয়ে কঠিন দিক হলো বাড়ির জন্য মন খারাপ করা। এখন বুঝছি, প্রিয়জনকে রেখে দূরে থাকা, না জানি তারা কেমন আছে—এই যন্ত্রণা তার চেয়েও বড়।’

আরেকজন লিখেছেন, ‘আমার মা বলেছে, অর্থ নেই, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আমাদের শহর ছেড়ে যেতে বলো না।’

এই ‘দ্য লাস্ট ফটো অফ হোম’ যেন শুধু একটি ট্রেন্ড নয়, এক অদৃশ্য আর্তনাদ। যেন এক নিঃশব্দ প্রতিবাদ—যুদ্ধের বিরুদ্ধে, অনিশ্চয়তার বিরুদ্ধে, হাহাকারের বিরুদ্ধে।

তারা জানে না—এই ঘরগুলো কখনো আবার ফিরে পাবে কি না। কিন্তু তবুও তারা ছবি তুলছে, স্মৃতিতে ধরে রাখছে ঘরটির প্রতিটি কোণ। হয়ত সেই স্মৃতিই একদিন ফিরিয়ে আনবে তাদের প্রিয় আশ্রয়টিকে।

ঢাকা এক্সপ্রেস/ এমআরএইচ

আরও পড়ুন