ঢাকা, বুধবার, ২৩ জুলাই ২০২৫

৭ শ্রাবণ ১৪৩২, ২৬ মুহররম ১৪৪৭

স্কুলের গাফিলতিতে চিকিৎসা ব্যাহত, হাসপাতালে স্বজনদের কান্না

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩:৫৪, ২২ জুলাই ২০২৫

স্কুলের গাফিলতিতে চিকিৎসা ব্যাহত, হাসপাতালে স্বজনদের কান্না

ছবি: ঢাকা এক্সপ্রেস

রাজধানীর উত্তরা এলাকার ঐতিহ্যবাহী মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্রে রক্তের গ্রুপ কিংবা অভিভাবকের মোবাইল নম্বর না থাকায় সোমবারের (২১ জুলাই) ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনার পর আহতদের চিকিৎসায় মারাত্মক জটিলতা তৈরি হয়েছে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে স্বজনদের আহাজারির পাশাপাশি ক্ষোভ দেখা গেছে উদ্ধারে নিয়োজিত পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবক ও চিকিৎসাকর্মীদের মধ্যেও। রক্তের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে তথ্যের অভাবে সময় নষ্ট হওয়ায় অনেকে চিকিৎসা শুরু করতেও দেরি করেছেন বলে অভিযোগ।

দুপুর ১টা ১৮ মিনিটে রাজধানীর উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান (এফ-৭) বিধ্বস্ত হয়ে সরাসরি আছড়ে পড়ে। 
 
বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কথা হয় আহত শিক্ষার্থী জারিন আফরিনের খালাতো বোন সাবিহা ইসলামের সঙ্গে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার বান্ধবীর মেয়ে স্কুলে পড়ে, জারিন। ওর অবস্থা ভালো না। ডাক্তার রক্ত লাগবে বলেছে। কিন্তু আমরা জানি না ওর রক্তের গ্রুপ কী। স্কুলের আইডি কার্ডে শুধু নাম, ক্লাস আর রোল। কোনো রক্তের গ্রুপ লেখা নাই, এমনকি গার্ডিয়ান নম্বরও না।’

সাবিহার মতো একই রকম অভিযোগ করতে দেখা গেছে আরো বেশ কয়েকজন অভিভাবক ও স্বজনকে। পরিচয়পত্র হাতে নিয়ে তারা প্রশ্ন করেন, ‘স্কুল যদি পরিচয়পত্র দেয়, তাতে সবচেয়ে জরুরি তথ্যগুলো কেন থাকবে না?’

এমন পরিস্থিতিতে হাসপাতালের সামনে উত্তেজনা তৈরি হয়। জরুরি বিভাগের ভেতরে কর্মরত একজন সিনিয়র নার্স নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘রক্ত দরকার কিন্তু গ্রুপ জানে না এমন ঘটনা আজ অন্তত ২০-২৫ জন শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে ঘটেছে। অনেক সময় রোগীর চেতনা থাকে না, আত্মীয় খুঁজে পাওয়া যায় না। তখন পরিচয়পত্রই ভরসা। কিন্তু এখানে পরিচয়পত্রে কোনো হেল্পলাইন নম্বর বা রক্তের গ্রুপ না থাকায় চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হয়েছে।’

দুর্ঘটনার পরে যখন পুলিশ ও র‍্যাব সদস্যরা ঘটনাস্থলে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেন, তখনও পরিচয় নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ে। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর শরীর আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হওয়ায় মুখ চেনা যাচ্ছিল না। পকেট থেকে পাওয়া স্কুল আইডি কার্ডে কোনো অভিভাবকের নম্বর, ঠিকানা কিংবা রক্তের গ্রুপ না থাকায় তাদের আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করাও দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে।

একজন উদ্ধারকর্মী বলেন, ‘আমরা একটা মেয়েকে পেয়েছি, গুরুতর আহত। তার ব্যাগে থাকা আইডি কার্ডে শুধু নাম, ক্লাস আর স্কুলের নাম লেখা। কোনো ফোন নম্বর নাই। কীভাবে তার পরিবারকে খবর দেব? এটা কী ধরনের পরিচয়পত্র?’

এ ঘটনার পর থেকেই স্কুল কর্তৃপক্ষের কোনো সদস্যকে হাসপাতালে দেখা যায়নি। স্থানীয় সাংবাদিকেরা মাইলস্টোন স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও সফল হননি। স্কুলের ল্যান্ডফোনে একাধিকবার কল করেও কেউ রিসিভ করেননি।

হাসপাতাল চত্বরে উপস্থিত এক অভিভাবক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘স্কুলে কত রকম রুলস, কত টাকা ফি নেয়, ইউনিফর্মের পেছনে পাগল করে দেয়—কিন্তু একটা ঠিকঠাক পরিচয়পত্র বানাতে পারে না? এটা অবহেলা না হলে কী?’

তিনি আরো বলেন, ‘সবার রক্তের গ্রুপ বাচ্চাদের ছোটবেলায় টেস্ট করানো থাকে। শুধু সেটা আইডিতে যুক্ত করলেই তো হতো। আর গার্ডিয়ান নম্বর রাখাও তো বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিয়ে কীভাবে এত উদাসীন হয় একটা নামী স্কুল?’

বিষয়টি নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক ও জরুরি চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘স্কুলগামী শিশুদের পরিচয়পত্রে রক্তের গ্রুপ, অভিভাবকের মোবাইল নম্বর ও কোনো মেডিকেল কন্ডিশন (যেমন হাঁপানি, অ্যালার্জি) থাকলে অনেক সময় জীবন বাঁচানো সম্ভব হয়। এটা অত্যন্ত জরুরি বিষয়। কিন্তু আমাদের দেশে এসব নিয়ম মানা হয় না, যার খেসারত দিতে হয় সংকটের সময়।’

তিনি বলেন, ‘সচেতন স্কুলগুলোর উচিত শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্র নিয়মিত আপডেট রাখা, এবং তা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রাখার নির্দেশ দেওয়া।’

রাত পর্যন্ত হাসপাতালে ভিড় করেছেন আহত শিক্ষার্থীদের আত্মীয়স্বজন। অনেকেই তাদের সন্তান কোথায়, কী অবস্থায় আছেন তা জানেন না। অসংখ্য স্বজনকে আইসিইউ, ওয়ার্ড ও মর্গে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। কেউ কেউ মোবাইল ফোনে পরিচিতদের ছবি দেখিয়ে খুঁজছেন। বারবারই উঠছে একই প্রশ্ন, ‘স্কুল আইডিতে যদি আরো কিছু তথ্য থাকত, তাহলে এতটা হয়রানি হতো না।’

ঢাকা এক্সপ্রেস/ইউকে

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন