শিরোনাম
ক্রীড়া ডেস্ক
প্রকাশ: ১৫:৩৮, ২৯ এপ্রিল ২০২৫ | আপডেট: ১৬:৩০, ২৯ এপ্রিল ২০২৫
বৈভব সূর্যবংশী । ছবি: সংগৃহীত
ভারতীয় প্রিমিয়ার লিগ বা আইপিএলে রেকর্ডের ছড়াছড়ি। আজ কেউ রেকর্ড গড়ে তো পরের দিন সেই রেকর্ড ভাঙে! কিন্তু সোমবার জয়পুরের মাঠে গুজরাট টাইটান্সের বিপক্ষে এক অবিশ্বাস্য রেকর্ড গড়ল বৈভব সূর্যবংশী। মাত্র ৩৫ বলের সেঞ্চুরি হাঁকাল এই ১৪ বছরের ক্রিকেটার। যা এই টুর্নামেন্টের ইতিহাসে দ্বিতীয় দ্রুততম শতরান। সামনে রয়েছেন শুধুমাত্র ক্রিস গেইল। আর ঝোড়ো ইনিংসে গুজরাটকে হারিয়ে শুভেচ্ছার বন্যায় ভাসল বৈভবের। তার খেলা দেখে হুইলচেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন রাহুল দ্রাবিড়। সোশাল মিডিয়ায় অভিনন্দন জানিয়েছেন ক্রিকেটের ‘ঈশ্বর’ শচীন টেণ্ডুলকর।
অর্থাভাবে একটা সময়ে ছেলের ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন শেষ হতে বসেছিল। কিন্তু হাল ছাড়েননি বাবা। নিজের শেষ সম্বল, একফালি জমি বিক্রি করে ছেলের স্বপ্নপূরণের রসদ জুগিয়েছেন। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করা সেই ছেলে মাত্র ১৪ বছর বয়সেই তোলপাড় ফেলে দিয়েছে ক্রিকেটদুনিয়ায়। কনিষ্ঠতম হিসাবে টি-২০ ক্রিকেটে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে।
গতবছর আইপিএল নিলাম থেকেই বিহারের বৈভবের রেকর্ড গড়ার যাত্রা শুরু। কনিষ্ঠতম ক্রিকেটার হিসাবে আইপিএল নিলামে দল পেয়েছিল সে। আইপিএল মহা নিলামে ১ কোটি ১০ লক্ষ টাকায় বৈভবকে কিনে নিয়েছিল রাজস্থান রয়্যালস। তারপর সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে আইপিএলে অভিষেক হয়েছে তার। আইপিএল জীবনের শুরুটাই করেছে ছক্কা হাঁকিয়ে। আইপিএল ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচে মারকুটে ব্যাটিং করলেও দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়তে পারেনি বৈভব। সেই আশা পূর্ণ হয়ে গেল সোমবার। আগের দিন হাফ সেঞ্চুরি মাঠে ফেলে এসে কেঁদেছিল ১৪ বছরের কিশোর। কিন্তু সোমবার জয়পুরে নিজের শতরান পূর্ণ করল বৈভব, মাত্র ৩৫ বলে। আইপিএলে এভাবে নজির গড়ার পথটা মোটেই সহজ ছিল না বৈভবের পক্ষে। বিহারের সমস্তিপুরের ছেলে বৈভব। সেখান থেকে ১০০ কিলোমিটার যাত্রা করে পাটনায় এসে প্রত্যেকদিন ৬০০টি বল খেলত সে। ১৬-১৭ বছর বয়সি নেট বোলারদের সামলে ব্যাটিং প্র্যাকটিস করত। নেট বোলাররা যেন প্র্যাকটিস করে, তাই তাদের জন্য বাড়তি খাবার নিয়ে আসতেন বৈভবের বাবা সঞ্জীব সূর্যবংশী। নিজের জমিটুকু পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়ে ছেলের খেলার খরচ জুগিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে, ভোর চারটের সময়ে উঠে বৈভবের জন্য প্রতিদিন খাবার বানিয়ে দিতেন তার মা। পরিবারের সকলের পরিশ্রমের ফল ঝলসে উঠছে বৈভবের পারফরম্যান্সে।
প্রথম ইনিংসে ব্যাটে ঝড় তুলেছিলেন গুজরাটের অধিনায়ক শুভমান গিল। ৫০ বলে ৮৪ রান করে সেঞ্চুরি মাঠে ফেলে আউট হন তিনি। এরপর জস বাটলারের ২৪ বলে হাফ সেঞ্চুরি গুজরাটকে পৌঁছে দেয় ২০৯-এ। খেলতে নেমে প্রথম থেকেই ঝড় তোলে বৈভব। আগের দিন যে হাফ সেঞ্চুরি মাঠে ফেলে এসে কেঁদেছিল ১৪ বছরের ক্রিকেটারটি। এদিন অনায়াসেই সেই বাধা টপকে যায় সে। মাত্র ৩৫বলে ছুঁয়ে ফেলে বহু কাঙ্ক্ষিত শতরান। আইপিএলে দ্রুততম শতরানের রেকর্ড রয়েছে ক্যারিবিয়ান তারকা ক্রিস গেইলের নামের পাশে। ৩০ বলে সেঞ্চুরি করেছিলেন। এদিন তাঁর পরেই খোদাই হয়ে গেল বৈভবের নাম। ৩৮ বলে ১০১ করে যখন প্যাভিলিয়নে ফিরছেন বৈভব ততক্ষণে ম্যাচে পকেটে পুড়ে ফেলেছে রাজস্থান।
তাঁরা যখন ক্রিকেট খেলতেন, তখন তাঁদের ভূমিকা ছিল ‘বিপদকালে’ দেশকে ভরসা দেওয়ার। একজন হয়ে উঠতেন ‘দ্য ওয়াল’, আরেকজনের ইনিংস হত ‘ভেরি ভেরি স্পেশাল’। আজ বৈভবের ইনিংসের ‘বৈভব’ দেখে অনেকেই চমকে গিয়েছেন। কিন্তু তার উত্থানের পিছনে রয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটের দুই স্তম্ভ- রাহুল দ্রাবিড় ও ভিভিএস লক্ষ্মণ।
আইপিএলে রাজস্থান রয়্যালসের জার্সিতে ১৪ বছরের বৈভবকে তৈরি করার পিছনে যে দ্রাবিড়ের কৃতিত্ব রয়েছে, সেটা তো প্রায় দেখাই যাচ্ছে। কিন্তু তাকে ‘খুঁজে’ বের করার পিছনে রয়েছে ভিভিএস লক্ষ্মণ। তার জন্য ফিরে যেতে হবে বিসিসিআইয়ের অনূর্ধ্ব-১৯ একদিনের চ্যালেঞ্জার টুর্নামেন্টে। সেখানে একটি ম্যাচে ৩৬ রানের মাথায় রান আউট হয়েছিল বৈভব। তারপর কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। বৈভবের ছোটবেলার কোচ মনোজ ওঝা বলছেন, “বৈভবকে কাঁদতে দেখে লক্ষ্মণ ওর কাছে আসে। বলেন, ‘আমরা শুধু কে কত রান করেছে, সেটা দেখছি না। আমরা দেখি, কাদের মধ্যে দীর্ঘদিন খেলার ক্ষমতা আছে।’ লক্ষ্মণ বুঝে নেন, ওর মধ্যে প্রতিভা আছে। বিসিসিআইও ওকে সাহায্য করেছে।”
কীভাবে? মনোজ বলছেন, ‘তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য বিহার আদর্শ জায়গা নয়। কোচ হিসেবে আমি চেয়েছিলাম, বিহারের বদলে অন্য কোনও রাজ্যের হয়ে ও খেলুক। যেখানে ও সুযোগ পাবে, সাহায্য পাবে।’ সেখানেই লক্ষ্মণের প্রবেশ। তিনি বৈভবকে সাহস জুগিয়েছিলেন। আর তারপর আইপিএলে রাহুল দ্রাবিড়ের ছত্রছায়ায় আশ্রয়। ১.১ কোটি টাকা দিয়ে তাকে কিনে নেয় রাজস্থান। কিন্তু প্রথম দিকে খেলায়নি। দ্রাবিড় নিজেই বলেছিলেন, মানিয়ে নেওয়ার জন্য বৈভবের আরেকটু সময় দরকার।
বৈভবের বাবা সঞ্জীব ও মা আরতি ধন্যবাদ দিচ্ছেন কোচ রাহুল দ্রাবিড়কে। সঞ্জীব বলছেন, “আমি রাহুল স্যর ও রাজস্থান ম্যানেজমেন্টকে ধন্যবাদ দিতে চাই। উনি আলাদা করে ওর সঙ্গে খেটেছেন। আজকের সেঞ্চুরি সেটারই ফসল।” ঘটনা হল, পায়ের চোটের জন্য রাহুল দ্রাবিড় আপাতত হুইলচেয়ারে বসেই কোচিংয়ের কাজ সামলাচ্ছেন। কিন্তু বৈভবের সেঞ্চুরি দেখার পর তিনিও আর বসে থাকতে পারেননি। লাফিয়ে উঠে হাততালি দিতে থাকেন। যেন এ তাঁর নিজের ‘সন্তান’-এর সাফল্য। দুই কিংবদন্তির হাতে তৈরি বৈভব। আরও অনেক পথ অপেক্ষা করে আছে তার জন্য।
ক্রিস শ্রীকান্ত একসময় বোলারদের পেটাতেন। সত্যি বলতে, ভারতীয় ক্রিকেটারদের মধ্যে সম্ভবত ক্রিস শ্রীকান্ত প্রথম দেখিয়েছিলেন, ওপেন করতে নেমে ভয়ডরহীন হয়ে যেকোনো বোলারকে মারা যায়। ১৯৮৩ বিশ্বকাপজয়ী এই ভারতীয় ওপেনার কাল নিজের এক্স অ্যাকাউন্টে মুগ্ধতা জানিয়েছেন বৈভবের পেটানো দেখে। শ্রীকান্ত লিখেছেন, ‘১৪ বছর বয়সে বেশির ভাগ বাচ্চা স্বপ্ন দেখে আর আইসক্রিম খায়। আর এদিকে বৈভব সূর্যবংশী আইপিএলের শিরোপার দাবিদার এক দলের বিপক্ষে অবিশ্বাস্য এক সেঞ্চুরি করল! বয়সের তুলনায় ওর সংযম, মান ও সাহস অনেক বেশি। নতুন এক মহাতারকার উত্থান দেখছি আমরা। ভারতীয় ক্রিকেটের পরবর্তী সুপারস্টার চলে এসেছে।’
এক্স হ্যান্ডেলে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ‘হার্ড হিটার’ ইউসুফ পাঠান, মোহাম্মদ সামি, যুবরাজ সিংরা। যুবি সোশাল মিডিয়ায় লিখেছেন, ‘১৪ বছর বয়সে তুমি কী করছ! পলক না ফেলে দুনিয়ার সেরা বোলার নিয়ে ছেলেখেলা করলে। বৈভব সূর্যবংশী-নামটা মনে রেখো। ভবিষ্যত প্রজন্মকে নিয়ে আমি গর্বিত।’
ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা ইনস্টাগ্রামে একটিই শব্দ লিখলেন—‘ক্লাস!’ এক শব্দে মুগ্ধতা সাবেক ভারতীয় স্পিনার হরভজন সিংয়েরও, ‘সুপারস্টার!’
সাবেক ভারতীয় ওপেনার সঞ্জয় মাঞ্জরেকার বললেন, ‘১৪ বছর বয়স, কিন্তু ওর ক্রিকেটের মাথাটা যেন ৩০ বছরের। বছরের পর বছর ধরে খেলা বোলারদের বিপক্ষে কী আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলল।’ সাবেক ভারতীয় ব্যাটসম্যান সুরেশ রায়না তো ভবিষ্যৎই বলে দিলেন, ‘একদিন ক্রিকেট শাসন করবে বৈভব সূর্যবংশী।’
রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে খেলে যাওয়া সাবেক ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠান লেখেন, ‘প্রথম ভারতীয় হিসেবে দ্রুততম শতরানের রেকর্ড ছিল আমার। তাও রাজস্থান রয়্যালসের জার্সিতে। তোমাকে সেই রেকর্ড ভাঙতে দেখে আমি মুগ্ধ। অনেক দূর যেতে হবে।’
বৈভব বলছে, ‘এসব আমি প্রায়ই করি। অনূর্ধ্ব-১৯ দল বা ঘরোয়া ক্রিকেটে, আমি প্রথম বলে ছয় মেরেছি। প্রথম দশ বল খেলার সময় একেবারেই চাপ নিই না। যদি আমার সীমার মধ্যে বল আসে, তাহলে ছক্কা মারবই। আমি আজ যেখানে, সেটা বাবা-মায়ের আশীর্বাদে। আমার মা রাত এগারোটার সময় ঘুমিয়ে তিনটের সময় উঠত, কারণ আমার প্র্যাকটিসের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। আমার বাবা কাজ ছেড়ে দিয়েছিল। বড়দাদাই এখন সেসব সামলায়। কিন্তু একটা কথা আমি বিশ্বাস করি, পরিশ্রম করলে ইশ্বর কখনও মুখ ফেরান না। আজ আমি যেটুকু আজ অর্জন করেছি, সেটুকু আমার বাবা-মায়ের আশীর্বাদে।’
ঢাকা এক্সপ্রেস/ এমআরএইচ