শিরোনাম
বিনোদন প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ: ১৯:৩০, ১৬ এপ্রিল ২০২৫ | আপডেট: ২০:১০, ১৯ এপ্রিল ২০২৫
হালের জনপ্রিয় সিনেমা ‘বরবাদ’। ঈদে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি দেখতে সকল বয়সী দর্শক ভিড় করেছেন। প্রশংসায় ভাসাচ্ছেন অনেকেই, তবে সচেতন দর্শকরা পরিবার নিয়ে দেখতে গিয়ে ধাক্কা খেয়েছেন। রাজধানীর এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সিনেমাটির সমালোচনা করে বলেন, ‘একজন সুপারস্টারের কাছ থেকে আমরা আরও বেশি সচেতনেতা আশা করছিলাম।’
কমল হাসানের উদাহরণটি টেনে তিনি বলেন, “সুপারস্টার শুধু বিনোদনের জন্যই অভিনয় করা উচিত নয়। তার কাজের ছাপ যেন সমাজের একটা বড় অংশের মানুষের মনে গেঁথে থাকে, সেটা অত্যাবশ্যকীয়। এটা তাঁর দায়বদ্ধতা। একজন শিক্ষকের যেমন দায়বদ্ধতা আছে, তেমনি অভিনেতাও এই সমাজের বাইরে নন। টাকা আয়ের ইচ্ছে থাকলে শাকিব খান এখন যে কোনো ব্যবসায় ইনভেস্ট করতে পারেন। দিনশেষে সিনেমা একটা শিল্প। ‘জীবন থেকে নেওয়া’র মতো আন্দোলিত সিনেমা সবাই বানাতে পারবেন না, তাই বলে সমাজকে কলুষিত করার শিক্ষা দেওয়ার অধিকার তো কেউ দেয়নি!”
এমনটা মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আফসার রায়হানও। তিনি বলেন, ‘সেন্সর বোর্ড কিভাবে অবাধে কোকেন খাওয়ার দৃশ্যে ছাড়পত্র দিয়েছে! মানুষের মস্তিষ্ক অভিযোজন ক্ষমতা সম্পন্ন। অর্থাৎ, আমরা যা দেখি, শুনি বা জানি, তার সবকিছুর সাথেই মস্তিষ্কের সংযোগ গড়ে ওঠে। সিনেমায় মারামারি দেখলে মারামারি করতে ইচ্ছে করে, প্রতিবাদ দেখলে নিজেও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। একজন নাম্বার ওয়ান নায়কের কোকেন খাওয়ার দৃশ্য কি যুব সমাজকে মোটেও প্রভাবিত করবে না!’
‘ওই জিল্লু মাল দে’- সিনেমা হল কাঁপানো ‘বরবাদ’ সিনেমার সবচেয়ে জনপ্রিয় সংলাপ। এই সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র আরিয়ান মির্জা (শাকিব খান) সিনেমায় দুই মিনিট পরপর ‘মাল’ খেতে চায়। বুঝতে সুবিধার জন্য, ‘কোকেন’সহ ভয়ঙ্কর সব মাদক মাল হিসাবে অভিহীত করেন ছবির মূল চরিত্র আরিয়ান। মেরে-কেটে প্রমাণ করেন ধনীর ছেলে হলে যা ইচ্ছ তাই করতে পারেন। পুলিশও তটস্থ থাকে এই ছেলের কাছে।
আলফা মেলের আরেক উদাহরণ ‘বরবাদ’
প্রেমিকার গলা চেপে ধরে, নির্মম ও নৃশংসভাবে মানুষকে হত্যা করে-এই হলো হিরো চরিত্র আরিয়ান! সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত রাগী, বিধ্বংসী, নারীবিদ্বেষী একটা চরিত্র। নারীবিদ্বেষকে দেখানো হয়েছে ‘আলফা মেল’ চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে। ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে এমন চরিত্রকে ‘পৌরুষের অধিকারী’ হিসেবে দেখানো হচ্ছে, যার মধ্যে মানবিকতাবোধ এবং স্বাভাবিক মানুষের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত, সেসবের ছিটেফোঁটাও নেই। এ যেন আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে আদিমকালে ফিরে যাওয়া। অনেকেই ফেসবুক স্ট্যাটাসে প্রশ্ন তুলেছেন, ‘এটা কি আদিকাল? আমরা কি জঙ্গলে বাস করি? উগ্র পুরুষতান্ত্রিক পুরুষ দর্শককে খুশি করে জঘন্যভাবে টাকা উপার্জনের সস্তা রাস্তা!’
‘বরবাদ’ ছবিতে শাকিব খান শারীরিকভাবে শক্তিশালী, রাগী, সহিংস, একরোখা, নিয়ন্ত্রণহীন চরিত্র দিয়েই হাততালি কুড়াচ্ছেন, সমাজে তা পৌরুষত্ব সম্পর্কে ভুল বার্তা দিচ্ছে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে।
অনেকেই বলছেন, এর পেছনে রয়েছে বলিউডের ব্লকবাস্টার হয়ে যাওয়া রণবীর কাপুরের ‘অ্যানিমেল’ ছবির ‘লার্জার দ্যান লাইফ’, ‘রাফ অ্যান্ড টাফ’ চরিত্রটি। ২০২৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘অ্যানিমেল’ সমালোচনার জেরেই ব্লকবাস্টার হয়ে যায়। এর ফলে অনেকেই ঝুঁকছে এমন চরিত্রে, সফল হলেন শাকিব খানও। ফলে জ্বলন্ত সিগারেট হয়ে উঠেছে পৌরুষের প্রতীক! যেন নিয়মকানুন, মানবিকতা, স্বাভাবিকতার কোনো বালাই-ই নেই।
একজন নারীর আদর্শ জীবনসঙ্গী তিনিই, যিনি তাঁর সেরা বন্ধু, গল্প করার মানুষ, আবেগীয় নির্ভরতার পরম জায়গা, যিনি আপনাকে প্রতিনিয়ত আপনার ‘সেরা ভার্সন’ হয়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করেন, যিনি ক্ষমা করতে জানেন, দুঃসময়টা যাঁর কাঁধে ভর করে সহজে পার করে ফেলা যায়।
সেন্সর বোর্ড কোথায় আছে
চার দশক আগে সেন্সর যুগের ইতি টেনেছে ভারত। ১৯৮৩ সালে সেন্সর বোর্ডের নাম বদলে সার্টিফিকেশন বোর্ড করেছে দেশটি। বাংলাদেশ গত বছরের সেপ্টেম্বরে সেই পথে হাঁটল! বাতিল হলো চলচ্চিত্রের ওপর গেঁড়ে থাকা সেন্সর প্রথা। সেন্সর বোর্ডের প্রধান কাজ ছবির ছাড়পত্র দেওয়া বা আটকানো। সার্টিফিকেশন বোর্ডের প্রধান কাজ কোন ছবি কোন বয়সের দর্শকের জন্য উপযোগী, তা নির্ধারণ করে দেওয়া। কিন্তু ‘বরবাদ’ সিনেমার ক্ষেত্রে এমন কিছু বিধিনিষেধ ছিল বলে জানা যায়নি।
কী কী কারণে কোনো ছবির সার্টিফিকেশন স্থগিত কিংবা বাতিল করা যাবে, তার একটা ফিরিস্তি সেন্সর আইনে ছিল। সার্টিফিকেশন আইনেও আছে। চাইলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বোর্ডের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আবেদন করতে পারেন। পাশাপাশি সেন্সর বোর্ডের মতো সার্টিফিকেশন বোর্ডেরও একটি আপিল কমিটি গঠনের কথা রয়েছে। এতে আপিলও দায়েরের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ‘বরবাদ’ যেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে।
কে কাকে আটকাবে
ভারতে নির্মাতা, প্রযোজক বা চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদেরই ‘দ্য সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশন’ (সিবিএফসি)–এর চেয়ারপারসনের দায়িত্বে থাকেন। বর্তমানে এর দায়িত্বে আছেন কবি, গীতিকবি ও চিত্রনাট্যকার প্রসূন জোশি। গত দুই দশকের সিবিএফসির চেয়ারপারসন ছিলেন চলচ্চিত্র প্রযোজক পেহলাজ নিহালানি, নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার লীলা স্যামসন, অভিনেত্রী শর্মিলা ঠাকুর, অভিনেতা অনুপম খের, অভিনেতা বিজয় আনন্দ, অভিনেত্রী আশা পারেখ, অভিনেতা অরবিন্দ ত্রিবেদী। বিপরীতে বাংলাদেশের সেন্সর বোর্ডে যারা রাজত্ব করেছেন এতদিন, তারা ভালো অভিনেতা-অভিনেত্রী হতে পারেন, কিন্তু সিনেমা নিয়ে কতটা জ্ঞান রয়েছে তা প্রশ্নবিদ্ধ। সেন্সর বোর্ডের নাকের ওপর দিয়ে একসময় যেমন অশ্লীল সিনেমা চলে আসত, তেমনি সমাজে ভুল বার্তা দেওয়া ছবিগুলোও অবাধে মুক্তি পাচ্ছে। সবকিছুর পেছনেই রয়েছে কিছু অদৃশ্য শক্তি।
চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের সমালোচনা
সেন্সর বোর্ডের বাঁধা নিয়ে সমালোচনা ছিল। বিগত দিনে সেন্সর বোর্ডের বাঁধাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন অনেক প্রযোজক-পরিচালক। এমনও হয়েছে, সারা বছর সিনেমা সংশ্লিষ্টরা এক নামে ছবির প্রচারণা করেছেন। কিন্তু মুক্তির সময় অযৌক্তিক কারণে নাম বদলের নির্দেশ দিয়েছে বোর্ড। কোনো কোনো প্রযোজক আজ প্রশ্ন তুলছেন, চলচ্চিত্রের মানুষেরা সেন্সর বোর্ডে থেকে চলতি শব্দ সিনেমা থেকে বাদ দিয়েছেন। ছবি আটকে দিয়েছেন। সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে দেয়নি। অথচ আজ কোথা থেকে আমদানি হলো শাকিব খানের আরিয়ান মির্জা চরিত্র। কেউ কেউ বলছেন, সরকার পতনের পর নতুন সেন্সর বোর্ড দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু এমন চরিত্র কিভাবে সিনেমা হল অব্দি আসলো! এখনো কি সেন্সর বোর্ডের পেছনে কালো হাত রয়েছে? ‘বরবাদ’ সিনেমার পোস্টারে শাকিব খানের যেই আঙ্গুল ঠোটে চেপে চুপ করানোর ভঙ্গি, সেটাতেই যেন চুপ রয়েছে বোর্ড।