শিরোনাম
সোহেল অটল
প্রকাশ: ১৮:৩৩, ২৬ মে ২০২৫ | আপডেট: ০৯:৫২, ২৯ মে ২০২৫
সব কাজ ফেলে চলছে আন্দোলন । ছবি: সংগৃহীত
এই প্রতিবাদের মধ্যে একটি গভীর প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে—রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধাভোগী এই কর্মচারীরা কীভাবে রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কেন্দ্রেই শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে আন্দোলনে নামেন? এবং তারা যে আচরণ করছেন, তা সরকারি চাকরিবিধির আওতায় আইন লঙ্ঘন নয় কি?
বর্তমানে দেশে প্রায় ১৫ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। তাঁরা নিয়মিত বেতন পান, পেনশন-ভাতা, চিকিৎসা ও আবাসন সুবিধা ভোগ করেন। এমনকি রাজনৈতিক অস্থিরতা বা দুর্যোগেও তাঁদের চাকরি সুরক্ষিত থাকে।
এমন সুবিধাভোগী শ্রেণি যখন নিজেদের কর্মক্ষেত্রেই বিক্ষোভে লিপ্ত হন, তখন প্রশ্ন ওঠে—তাঁদের এ কর্মসূচি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে তাঁদের দায়িত্বের পরিপন্থী নয় কি?
‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এ বলা হয়েছে, যদি কোনো সরকারি কর্মচারী এমন কাজে লিপ্ত হন যা অনানুগত্যের শামিল, বা অন্যদের মধ্যে শৃঙ্খলাভঙ্গ সৃষ্টি করে, কিংবা সম্মিলিতভাবে কর্মবিরতি করেন—তাহলে সেটি “অসদাচরণ” বলে গণ্য হবে। শাস্তির তালিকায় রয়েছে পদাবনতি, চাকরিচ্যুতি কিংবা বরখাস্ত।’
আইন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, এই অধ্যাদেশ কর্মচারীদের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এর কিছু ধারা অস্পষ্ট। তাই সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের আলোকে মতপ্রকাশ ও সংগঠনের অধিকারের প্রশ্নও আসতে পারে।
তারা এও বলছেন, আন্দোলনের পদ্ধতি যদি হয় কর্মস্থল ত্যাগ, প্রশাসনিক অচলাবস্থা, তাহলে সেটা রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ বলে বিবেচিত হবে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলন একাধিকবার দেখা গেছে। ১৯৯০-এর দশকে পদোন্নতি ও বেতন কাঠামোর দাবিতে তারা আন্দোলন করেছেন, এমনকি সচিবালয়ের গেটও অবরুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু তখন আন্দোলনের ভাষা ও কৌশল ছিল সীমিত এবং প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করার মতো মাত্রায় পৌঁছায়নি।
বর্তমান আন্দোলনে যে মাত্রা দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে সচিবালয়ের মূল ফটক বন্ধ, কর্মস্থলে উপস্থিত না থাকা, তা এক ধরনের প্রশাসনিক বিদ্রোহের ইঙ্গিত দেয়—যেটা আগের তুলনায় অনেক বেশি অগ্রহণযোগ্য।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী মানে এমন কেউ, যিনি জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর বেতন, সুযোগ-সুবিধা জনগণের করের টাকায় চলে। সংবিধান অনুযায়ী তিনি রাষ্ট্রের সেবক, প্রভু নন।
সচিবালয়ের আন্দোলন প্রসঙ্গে একটি উল্লিখিত দিক হলো—এ আন্দোলন শুধুমাত্র নীতির প্রশ্নে নয়, বরং প্রশাসনের নিজস্ব সুবিধা সংরক্ষণের প্রয়াস হিসেবে দেখা যাচ্ছে। এতে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব, জনগণের প্রতিনিধিত্ব ও প্রশাসনিক জবাবদিহিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
আন্দোলনকারীরা এই অধ্যাদেশকে ‘কালো আইন’ আখ্যা দিলেও এখন পর্যন্ত কোনও বিকল্প খসড়া, সংশোধনী বা সংলাপের উদ্যোগ নেননি। বিষয়টিকে কেবল একতরফা চাপ প্রয়োগে পরিণত করেছেন।
আবার প্রশ্ন আসে—রাষ্ট্রের ভিতর থেকে রাষ্ট্রেরই কার্যক্রম ব্যাহত করে দাবি আদায় কি প্রজাতন্ত্রের চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না?
বাংলাদেশে যত দুর্নীতির ঘটনা সামনে আসে, তার অধিকাংশই ঘটে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগসাজশে। চাহিদার বাইরে সুবিধা আদায়, ঘুষ, কমিশন, কাজের বিলম্ব—সবকিছুতেই একটা 'অদৃশ্য অথচ সক্রিয় আমলাতান্ত্রিক বাধা' কাজ করে। রাষ্ট্র থেকে বিদেশে অর্থ পাচারের ঘটনার উল্লেখযোগ্য অংশেও ভূমিকা রাখে এই সরকারি কর্মচারী শ্রেণি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাষ্ট্রকে অকার্যকর করে ফেলার পেছনে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশাপাশি অন্যতম দায় বর্তায় আমলাদের উপর। তাঁরা প্রশাসনের যন্ত্র হিসেবে কাজ করার বদলে কখনো কখনো হয়ে ওঠেন রাষ্ট্রের ছদ্ম-নিয়ন্তা। দুর্নীতিগ্রস্ত এই কাঠামোর সুযোগ নিয়ে তাঁরা রাষ্ট্রীয় সম্পদ ভোগ করেন, অথচ দায়দায়িত্ব বা জবাবদিহিতা নেন না।
এই বাস্তবতায় প্রশ্ন ওঠে—তাঁদের এই আন্দোলন কি প্রকৃতপক্ষে ন্যায্য অধিকার রক্ষার প্রয়াস, নাকি আরও ভোগের স্বাধীনতা চাইবার এক নতুন কৌশল? যে শ্রেণি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী, তাঁরাই যদি রাষ্ট্রের ভিতরে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের স্থিতি নষ্ট করেন, তবে সেটাকে কীভাবে দেখা উচিত—এই প্রশ্নটি উঠছে সাধারণ মানুষের মুখেও।
সরকারি কর্মচারীদের দাবির যৌক্তিকতা থাকতে পারে, কিন্তু দাবি আদায়ের উপায় যদি হয় প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ভাঙা, জনগণের সেবা স্থগিত রাখা, তাহলে তা কখনই গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী শ্রেণি হয়ে যদি তাঁরা রাষ্ট্রের কাঠামোকেই বিপন্ন করেন, তাহলে প্রশ্ন উঠবেই—তাঁরা আসলে কাদের প্রতিনিধি?
ঢাকা এক্সপ্রেস/ এসএ