ঢাকা, শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫

২৫ বৈশাখ ১৪৩২, ১১ জ্বিলকদ ১৪৪৬

লালপুর গ্রামের উৎপাদিত শুটকি রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে

হাবিবুর রহমান পারভেজ , ব্রাহ্মণবাড়িয়া

প্রকাশ: ২২:৫৫, ৭ মে ২০২৫

লালপুর গ্রামের উৎপাদিত শুটকি রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে

লালপুর গ্রামে প্রস্তুত করা হচ্ছে শুটকি। ছবি ঢাকা এক্সপ্রেস

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার লালপুর গ্রাম সংলগ্ন মেঘনা নদীর তীরে উৎপাদিত শুটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের দেশগুলোতে রপ্তানি হচ্ছে। মেঘনা ও তিতাস নদীর মিঠা পানির চ্যাপাসহ ১৬ প্রজাতির মাছের শুটকি তৈরি হচ্ছে এ গ্রামে।  প্রতি মৌসুমে প্রায় এক লাখ মণ শুটকি বিক্রি করে বছরে প্রায় ১০ কোটি টাকা আয় করছে এখানকার স্থানীয় শুটকি ব্যবসায়িরা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, লালপুর গ্রাম সংলগ্ন মেঘনার তীরে প্রায় দুই শতাধিক মাচার (ডাঙ্গি) ওপর মাছ শুকিয়ে শুটকি তৈরি করা হচ্ছে। যেদিকে চোখ যায় শুধু শুটকি আর শুটকি। প্রথমে শুধু চ্যাপা শুটকি তৈরি হলেও এখন প্রায় ১৬ প্রজাতির মাছের শুটকি উৎপাদিত হচ্ছে বলে স্থানীয় শুটকি ব্যবসায়িরা জানিয়েছেন। বছরের আশ্বিন থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত চলে শুটকি উৎপাদনের কাজ।

যেভাবে তৈরি হচ্ছে শুটকি:
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ, নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর, নাছিরনগর ও কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন ও তাড়াইল হাওর অঞ্চলের বিভিন্ন নদী-নালা, বিল, পুকুর, ডোবা ও খালে উৎপাদিত মাছ সংগ্রহ করে নদীপথে লালপুরে নিয়ে আসা হয়। পরে এসব মাছ কেটে মাচায় শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে শুটকি তৈরি হয়। 

তৈরির প্রক্রিয়া:
প্রথমে নারী শ্রমিকরা মাছের পেট কেটে পিত্ত ফেলে দেন। পরে নদীতে ময়লা পরিষ্কার করেন। এরপর এসব কাটা মাছ রোদে শুকানোর জন্য মাচায় রাখা হয়। প্রায় ৪/৫ দিন রোদে শুকানোর পর প্রক্রিয়াজাত করে শুটকি তৈরি করা হয়।

বিভিন্ন জাতের শুটকি:
কেচকি, আলুনি, পুঁটি, ভেদি, গজার, গইন্না, বোয়াল, টেংরা, চাপিলা, চিকরা, স্টারবাইম, চাঁন্দা, বেটা গুলাইয়া, বাইল্লা, কাইখ্যা ও লংবাইম এই ১৬ প্রজাতির মাছের শুটকি তৈরি করা হয়। এর মধ্যে দেশে-বিদেশে পুঁটি ও ভেদি মাছ দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি চ্যাপা শুটকির চাহিদাই বেশি। এই চ্যাপা শুটকিকে স্থানীয় অনেকে শীদল শুটকিও বলে।

চ্যাপা শুটকি প্রক্রিয়াকরণ:
বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করা পুঁটি ও ভেদি মাছ মাচার (ডাঙ্গি) উপর রেখে ২/৩ দিন শুকানো হয়। এরপর মাছের তেলে ভিজিয়ে মাটির তৈরি মটকায় রাখা হয়। পরে পলিথিন দিয়ে মটকার মুখ ভালোভাবে বেঁধে ছায়া ঘেরা আর্দ্র স্থানে রাখা হয়।

দরদাম:
প্রতি কেজি পুঁটি মাছের শুটকি ১৮০ টাকা, চাঁন্দা ১১০, টেংরা ১৭০, গজার ৩০০, গইন্না ৩০০, চাপিলা ১৫০, কাইখ্যা ২১০, চিকরা বাইম ১৬০, বোয়াল ২৫০ ও বজুরী ১২০ টাকায় পাইকারি দরে বিক্রি করছেন উৎপাদনকারীরা। আর প্রতি কেজি চ্যাপা শুটকি বিক্রি করা হচ্ছে ২৫০ থেকে ২৮০ টাকায়।

মাছের ভুড়ি থেকে তৈল:
মাছের নাড়ি-ভুড়ি চুলায় জ্বাল দিয়ে তৈল তৈরি করা হয়। এ তৈল সাধারণত চ্যাপা শুটকি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এর প্রতি কেজি তৈল ৮০০ থেকে এক হাজার টাকায় বিক্রি হয়।

পাঁচ শতাধিক নারীর কর্মসংস্থান:
লালপুর গ্রামের প্রায় পাঁচ শতাধিক নারী শ্রমিক শুটকির জন্য মাছ কাটা এবং ধোয়ার কাজ করেন। তবে বিনিময়ে তারা প্রতিদিন যে মজুরি পান তা খুবই নগন্য।

সেখানকার এক নারী শ্রমিক রত্না দাস বলেছেন, ‘সারাদিন কাজ করে মাত্র ৪০/৫০ টাকা পাই। কিন্তু এই মজুরিতে আমাদের সংসার চলে না।’ 

শুটকি ব্যবসায়ীদের কথা:
শুটকি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত লালপুর ও পার্শ্ববর্তী কান্দাপাড়া গ্রামের ননী গোপাল দাস, অবিনাশ দাস, বিনোদ চন্দ্র দাস, রঞ্জিত দাস ও তপন দাস জানান, শুটকি ব্যবসায় অনেক আয় হলেও পুঁজির অভাবে অনেকে এ ব্যবসা করতে পারছেন না। আর বিভিন্ন এনজিও এবং দাদন ব্যাবসায়ীর কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে কিস্তির টাকা শোধ করে ব্যবসা চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে অনেককে। এছাড়া সুদের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে অনেকে সর্বহারাও হয়েছেন। 

তারা আরো বলেছেন, ‘শুটকি উৎপাদনের জন্য সরকার যদি সহজ শর্তে ব্যাংক থেকে ঋণের ব্যবস্থা করে তাহলে আমরা এ পেশায় টিকে থাকতে পারব। আর শুটকি উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মূদ্রাও অর্জন করা সম্ভব হবে’।

শুটকি সরবরাহ ও রপ্তানি:
লালপুরে উৎপাদিত শুটকির চাহিদা দেশে ও দেশের বাইরে ব্যাপক। এখানকার উৎপাদিত শুটকিতে কোন প্রকার রাসায়নিক দ্রব্য ও লবণ মেশানো থাকেনা। এ এলাকায় বছরে প্রায় এক লাখ মণ শুটকি তৈরি হয়। এসব শুটকি ঢাকা, চট্রগ্রামসহ সারা দেশে সরবরাহ করা হয়। তবে গত পাঁচ বছর ধরে রপ্তানিকারকরা ভারত, সৌদি আরব, দুবাই, ইতালি, ইংল্যান্ড সহ বেশ কয়েকটি দেশে এখন লালপুরের চ্যাপা ও অন্যান্য শুটকি রপ্তানি করছে।

লালপুর গ্রামে শুটকি বিক্রি করে বছরে প্রায় ১০ কোটি টাকা আয় হয় বলে জানান স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে শুটকি রপ্তানি করে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা ।

 

ঢাকা এক্সপ্রেস/ এসইউ

আরও পড়ুন