শিরোনাম
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১১:৫৪, ১৮ জুন ২০২৫ | আপডেট: ১১:৫৭, ১৮ জুন ২০২৫
ছবি: সংগৃহীত
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বারবারের দুর্ভোগের পেছনে রয়েছে অপর্যাপ্ত ও অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, দখল ও ভরাট হওয়া খাল, বেহাল রাস্তার কাঠামো এবং নাগরিকদের অসচেতনতা। দুই সিটি করপোরেশন মাঝে মাঝেই খাল পরিষ্কারের উদ্যোগ নিলেও তা কার্যকর হচ্ছে না, কারণ ড্রেনগুলো অনেক সময়েই বন্ধ পড়ে থাকে কিংবা স্লুইস গেটগুলো নির্ধারিত সময়ে কাজ করে না।
এই কারণেই প্রতিবছর বর্ষা এলেই নতুন কোনো দুর্ভোগ নয়, পুরোনো ভোগান্তির পুনরাবৃত্তি ঘটে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, মঙ্গলবার (১৭ জুন) সকালে হালকা ও মাঝারি মাত্রার থেমে থেমে বৃষ্টিতে রাজধানীর রাজারবাগ, সূত্রাপুর, বংশালসহ বিভিন্ন এলাকায় পানির স্তর দ্রুত বেড়ে যায় এবং ঘন্টার পর ঘণ্টা জমে থাকে। এমনকি পানি সরে যেতে কোনো কোনো জায়গায় ১২ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। বাসিন্দারা বাধ্য হয়ে পানি ভেঙে চলাফেরা করেছেন, অনেকেই কর্মস্থলে পৌঁছাতে পারেননি সময়মতো।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বারবার বলছেন, রাজধানী ঢাকার এই দুর্ভোগের মূল কারণ এর ভৌগোলিক গঠন ও নগর ব্যবস্থাপনার দূরদৃষ্টিহীনতা। ঢাকার প্রাকৃতিক ঢাল পূর্ব-পশ্চিমমুখী হলেও নগরায়নের সময় পরিকল্পনাবিদরা সে প্রবাহ উপেক্ষা করে সড়ক ও ড্রেন বানিয়েছেন উত্তর-দক্ষিণমুখীভাবে। ফলে নদী বা খালের দিকে পানি যাওয়ার পথ কার্যত বাধাগ্রস্ত হয়েছে। একাধিক এলাকায় বড় বড় সড়ক ও দালান খালের স্বাভাবিক গতিপথের উপর গড়ে তোলা হয়েছে, ফলে জল আটকে যাচ্ছে। অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, আমাদের অবকাঠামো প্রকৃতিবিরোধী। ফলে প্রাকৃতিক জলপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে এবং সে কারণেই সামান্য বৃষ্টিতেই পুরো নগরী অচল হয়ে পড়ছে।
এদিকে ঢাকায় যতটুকু নালা-নর্দমা রয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। তার ওপর, এই অল্প সংখ্যক ড্রেন ও নালাগুলোর একটি বড় অংশই প্রায় অকার্যকর অবস্থায় পড়ে আছে। ময়লা, আবর্জনা, পলিথিন, নির্মাণসামগ্রী, এমনকি বালু-কংক্রিট পর্যন্ত ড্রেনের মুখ বন্ধ করে রাখছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, নিয়মিত পরিষ্কার কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও নাগরিকদের অসচেতনতা ও অসহযোগিতার কারণে এই সমস্যা থেকে সহজে উত্তরণ সম্ভব হচ্ছে না।
এমনকি মে মাসের শেষ দিকে হঠাৎ বৃষ্টিতে রাজধানীর লালবাগ, নিমতলী, বংশালসহ বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে ছিল তিন থেকে চার দিন পর্যন্ত। ঢাকা উত্তরের বিভিন্ন এলাকাও একই দুর্ভোগের শিকার হয়। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলায় সিটি করপোরেশন তাৎক্ষণিকভাবে ‘জরুরি সাড়াদানকারী দল’ মোতায়েন করলেও, পানির দ্রুত নিষ্কাশনে কাঙ্ক্ষিত ফল মেলেনি।
ঢাকা দক্ষিণে বর্তমানে ৫৫টি স্লুইস গেট রয়েছে, যার মধ্যে ৩৭টি বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এবং ১৮টি কামরাঙ্গীরচরে অবস্থিত। এসব স্লুইস গেট কার্যকর থাকলেও বৃষ্টির সময় যদি নদীর পানি বেড়ে যায়, তবে নগরীর জমে থাকা পানি আর নদীতে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে জলাবদ্ধতা দীর্ঘায়িত হয়। একইভাবে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বর্ষার আগেই ১০০ কিলোমিটারের বেশি এলাকায়— যেমন আবদুল্লাপুর, বাউনিয়া, কল্যাণপুর, মহাখালীসহ ২৯টি খাল দখলমুক্ত করে পরিষ্কার করেছে। কিন্তু এত পরিশ্রমের পরও ঢাকার জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলছে না।
ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তরের বিভিন্ন এলাকায়— যেমন ধানমণ্ডি ২৭, আশকোনা, বনশ্রী, বেগুনটিলা, পশ্চিম কাজীপাড়া, কাঁঠালবাগান, মগবাজার ডাক্তার গলি, যমুনা ফিউচার পার্ক, কাওলা, খিলক্ষেত, আগারগাঁও, মিরপুর ১৪, রূপনগর, ইব্রাহিমপুর বাজার, উত্তরা সেক্টর ৩, মালিবাগ চৌধুরীপাড়া, পল্লবী, ভাটারা এবং ওয়াজউদ্দিন রোড এলাকাজুড়ে জলাবদ্ধতা নিরসনের কাজ চললেও প্রতিটি বৃষ্টিতেই পরিস্থিতি প্রায় অপরিবর্তিত রয়ে যায়।
মঙ্গলবার সকাল থেকেই রাজারবাগ পুলিশ লাইনস এলাকা এবং তার আশপাশে থেমে থেমে বৃষ্টিতে হাঁটুপানি জমে যায়। বিশেষ করে মালিবাগ থেকে রাজারবাগ পর্যন্ত রাস্তার একাংশে পানি জমে যায়। অফিসগামী মানুষজন জুতা হাতে নিয়ে পানি ভেঙে রাস্তায় হাঁটতে বাধ্য হন। রিকশাচালকরাও বেশ বেকায়দায় পড়েন। স্থানীয় দোকানি শরীফ মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বৃষ্টি হলেই রাস্তায় পানি জমে যায়। ড্রেনেজ ব্যবস্থা কার্যকর নয় বলেই এই দুর্ভোগ। ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে প্রতিদিন।
রাজারবাগে কর্মরত পুলিশ সদস্য আমিনুল ইসলাম বলেন, বৃষ্টি থেমে গেলেও পানি নামতে অনেক সময় লাগে। ইউনিফর্ম ভিজে যায়, যার কারণে আমাদের কাজেও সমস্যা হয়। সাধারণ মানুষ আরও বেশি কষ্টে পড়ে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, আমরা ইতোমধ্যেই ১০৮ কিলোমিটার খাল পরিষ্কার করেছি, জরুরি সময়ের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা রেখেছি। ৫৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হলেও এবার দেখা গেছে, প্রধান সড়কে পানি জমেনি। এটি সম্ভব হয়েছে পরিকল্পিতভাবে অল্প খরচে কাজ করার মাধ্যমে। ভবিষ্যতে যদি এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়, তাহলে ঢাকাকে বদলে ফেলা সম্ভব।
তবে নগরবাসী জানেন, শুধু পরিকল্পনা নয়, প্রয়োজন তার বাস্তবায়ন। আর সেই বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং নাগরিকদের সচেতন অংশগ্রহণ। না হলে প্রতি বর্ষায় এই চিত্রের পুনরাবৃত্তি চলতেই থাকবে।
ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ