ঢাকা, বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫

৩১ আষাঢ় ১৪৩২, ২০ মুহররম ১৪৪৭

সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুল তথ্যের ছড়াছড়ি, বিভ্রান্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২:০৮, ১২ জুলাই ২০২৫

সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুল তথ্যের ছড়াছড়ি, বিভ্রান্তি

ছবি: সংগৃহীত

বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তথ্যের আদান-প্রদান যেমন দ্রুত এবং ব্যাপক, তেমনি এটি ভুল এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর ভয়াবহ প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে। ফেসবুক, টুইটার (বর্তমানে এক্স), ইউটিউব, টিকটকসহ অন্যান্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রতিদিনই এমন সব গুজব, মিথ্যা খবর এবং বিকৃত তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, যেগুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি, আতঙ্ক এবং সামাজিক উত্তেজনা তৈরি করছে। যেহেতু অধিকাংশ ব্যবহারকারী সঠিক তথ্য যাচাই না করেই এগুলো বিশ্বাস করে ফেলছেন, সেজন্য এর প্রভাব আরো ভয়াবহ হয়ে উঠছে।

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দাবি করা হচ্ছে দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেছে। এটি দেখার পর হাজারো মানুষ তা শেয়ার করেছে, মন্তব্য করেছে এবং আরো অনেকেই এই তথ্য বিশ্বাস করে নিয়েছে। কিন্তু, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মতে, ওই ভিডিওটির কোনো বাস্তব ভিত্তি ছিল না। ভিডিওটি সম্পূর্ণভাবে একটি মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা ছিল; যা সমাজে আতঙ্ক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি জনবিশ্বাসের সংকট তৈরি করার লক্ষ্যেই নির্মিত হয়েছে। এটি কেবল আর্থিক খাতেই নয়, বরং ধর্মীয়, রাজনৈতিক এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়েও প্রতিনিয়ত ছড়ানো হচ্ছে নানা গুজব এবং ভুল তথ্য। অনেক সময় এমনও দেখা যায় যে, ‘কোনো এক তারকা মারা গেছেন’ কিংবা ‘কোনো নতুন ওষুধে করোনা সারবে’— এ ধরনের গুজব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হয়; যা জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।

এভাবে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষও। ঢাকা শহরের মিরপুরের বাসিন্দা মনোয়ারা বেগম (৫২) বলেন, ফেসবুকে দেখলাম, কোথাও খুব সস্তায় গ্যাস-চালিত কুকার বিক্রি হচ্ছে। আমি অর্ডার দিলাম, কিন্তু পরে দেখলাম সেই পেজটি আর পাওয়া যাচ্ছে না। আমার তিন হাজার ৫০০ টাকা চলে গেল!
আবার, তেজগাঁওয়ের বাসিন্দা ও সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, কয়েক দিন ধরে অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের ছবি এবং মন্তব্য দেখছি। এখন কোনটা সত্যি, আর কোনটা মিথ্যা, আমি নিজেই জানি না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি, তারপরেও বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছি। সাধারণ মানুষ তো আরো বিপদে পড়ে।

মনোয়ারা এবং সাবিনার মতো হাজারো মানুষ প্রতিদিন বিভিন্ন গুজব, ভুল তথ্য এবং প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। এসব গুজব এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য কখনো কোনো ব্যক্তিকে বা প্রতিষ্ঠানে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, আবার কখনো এটি সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করছে। এমনকি, এটি কখনো কখনো সহিংসতা পর্যন্ত উসকে দিতে পারে। একটি মিথ্যা পোস্ট কিংবা বিভ্রান্তিকর ছবি-ক্যাপশন অনেক সময় পুরো সমাজকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম। একটি গুজবের কারণে নিরপরাধ মানুষও অনাহূত বিপদে পড়তে পারেন।

বর্তমানে প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে এই সমস্যা আরো প্রকট হয়ে উঠেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহার করে এমন ভিডিও তৈরি করা এখন খুব সহজ হয়ে গেছে, যা দেখে আসল এবং নকল ভিডিও চিহ্নিত করা প্রায় অসম্ভব। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মাধ্যমে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা আরো সহজ হয়ে গেছে। এর ফলে মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া এবং ভুল তথ্যের বিস্তার ঘটানো খুব সহজ হয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে, সরকারের পক্ষ থেকে একটি কেন্দ্রীয় ফ্যাক্টচেকিং ইউনিট গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। অন্যান্য দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি ওয়েবপোর্টাল রয়েছে, যেখানে প্রতিদিনের ভুল তথ্য যাচাই করে সঠিক তথ্য প্রদান করা হয়। বাংলাদেশেও সরকারের উচিত এমন একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি আরো শক্তিশালী করতে সহায়তা করবে। একইসঙ্গে যারা এসব গুজব ছড়িয়ে দেয়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রযোজ্য করা উচিত।

সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর জোহা বলেন, অনলাইন এখন একটি প্রতারণার জায়গায় পরিণত হয়েছে। যেখানে বিভিন্ন ধরনের চটকদার বিজ্ঞাপন এবং প্রতারণা করা হচ্ছে। ইভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠান থেকে মানুষ যে ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছে, সেটি এখনো চলমান। তাই, আমাদের উচিত যেকোনো তথ্য বা পণ্য সম্পর্কে ভালোভাবে জানিয়ে-বুঝে ব্যবহার করা এবং এটি যাচাই করার জন্য বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. খোরশেদ আলম বলেন, বর্তমানে অনলাইনে ভুল তথ্য এবং গুজবের বিস্তার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এসব তথ্য মানুষকে বিভ্রান্ত করছে, সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করছে এবং কখনো কখনো সহিংসতা পর্যন্ত উসকে দিচ্ছে। একটি মিথ্যা পোস্টের কারণে একটি নিরপরাধ ব্যক্তি হুমকির মুখে পড়তে পারেন এবং ভুয়া ছবি বা ক্যাপশন দিয়ে পুরো সমাজকে বিভ্রান্ত করা যেতে পারে। এটি যদি এখনই রোধ করা না হয়, তবে ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মগুলোও এই দায় এড়াতে পারে না। অনেক সময় বারবার রিপোর্ট করার পরও কোনো গুজব বা ক্ষতিকর কনটেন্ট সরানো হয় না, এবং ‘এনগেজমেন্ট’ বাড়ানোর জন্য অ্যালগরিদম সেগুলো আরো বেশি মানুষকে দেখানোর ব্যবস্থা করে দেয়। এর ফলে, গুজব এবং ভুল তথ্যের বিস্তার আরো দ্রুত ঘটে।

অপতথ্যের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার গুরুত্ব তুলে ধরে গত ২ জুলাই এক সভায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ভুল বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তথ্য শুধুমাত্র জনমতকে বিভ্রান্ত করে না, বরং রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা ও সামাজিক শান্তিকেও বিঘ্নিত করে।

তিনি আরো বলেন, অপতথ্য প্রতিরোধে কেবল রাষ্ট্র নয়, সাধারণ মানুষেরও সচেতন ভূমিকা থাকতে হবে। গণমাধ্যম, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে একটি টেকসই এবং নৈতিক তথ্যব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।

এ সমস্যার সমাধানে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি শুধু রাষ্ট্রের একার কাজ নয়, বরং ব্যক্তি, পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এবং রাষ্ট্রসহ সব স্তরের সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে এটি রোধ করা সম্ভব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ব্যবহারকারীদের তথ্য যাচাইয়ের অভ্যাস গড়ে তোলা। সরকারি পর্যায়ে দ্রুত ফ্যাক্টচেক এবং জনসচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। পাশাপাশি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলোকে আরো দায়িত্বশীল করে তুলতে হবে।

ডিজিটাল বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, তথ্যের এই যুগে ভুল তথ্য এখন সবচেয়ে বিপজ্জনক অস্ত্র। বিভ্রান্তি তৈরি করে সমাজে বিভাজন, বিশৃঙ্খলা এবং ক্ষতি ডেকে আনছে। তাই, এখন সময় এসেছে ‘তথ্য’ নয়, ‘সত্য’ যাচাই করার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু শেয়ার করার আগে একাধিকবার ভাবতে হবে যে, এটি কোনো বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে কিনা বা এটি এমন কিছু তথ্য দেয় না তো, যা মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা বা আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে?

ঢাবি শিক্ষক ডা. খোরশেদ আলমের মতে, এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য জনগণকে তথ্য যাচাইয়ে সচেতন হতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে সতর্কতা এবং মিডিয়া লিটারেসি বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি, সরকার, গণমাধ্যম এবং প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। ভুল তথ্য ছড়ালে শুধু অনলাইন নয়, বাস্তব জীবনেও তার পরিণতি ভয়ংকর হতে পারে— এ কথা সমাজকে বুঝতে হবে।

ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, বর্তমান ডিজিটাল যুগে তথ্য যাচাই (ফ্যাক্ট-চেকিং) ও গবেষণাভিত্তিক প্রতিবেদন তৈরি অত্যন্ত জরুরি। গুজব ও অপতথ্য রোধে ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়াতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ সঠিক তথ্য চিনে নিতে পারে। ভুয়া অ্যাকাউন্ট শনাক্ত ও রিপোর্ট করা, বিশ্বাসযোগ্য প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার এবং এআই প্রযুক্তি দিয়ে তথ্য বিশ্লেষণ করাও এখন সময়ের দাবি। একই সঙ্গে সাইবার অপরাধ দমনে কঠোর আইন প্রয়োগ, অনলাইনে নজরদারি এবং কমিউনিটি পর্যায়ে রিপোর্টিং সিস্টেম চালু করতে হবে।

তিনি বলেন, স্কুল-কলেজ পর্যায়ে ‘ডিজিটাল নাগরিকতা’ ও ‘তথ্য বিশ্লেষণ’ শিক্ষা চালু করলেই মিডিয়া লিটারেসি বাড়বে— যা গুজব প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

ঢাকা এক্সপ্রেস/আরইউ

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন