নারী অধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ। তার এক্স (পূর্বে টুইটার) হ্যান্ডলে একটি ভিডিও রিপোস্ট করার পর থেকেই এই আলোচনার সূত্রপাত হয়। ভিডিওটিতে দেখা যায়, একটি খ্রিষ্টান জাতীয়তাবাদী গির্জার কয়েকজন যাজক নারীদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার পক্ষে বক্তব্য দিচ্ছেন।
ঘটনাটি ঘটে গত বৃহস্পতিবার রাতে। হেগসেথের এই পোস্ট তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও ধর্ম-ভিত্তিক চরমপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি অনুরাগের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রীর শেয়ার করা ভিডিওটি সিএনএনের প্রায় সাত মিনিটের একটি প্রতিবেদন থেকে নেওয়া। প্রতিবেদনে কমিউনিয়ন অব রিফর্মড ইভানজেলিক্যাল চার্চেস (সিআরইসি)-এর সহপ্রতিষ্ঠাতা ডগ উইলসনের কার্যক্রম তুলে ধরা হয়। সেখানে উইলসনের চার্চের এক যাজক সরাসরি মার্কিন সংবিধান থেকে নারীদের ভোটাধিকারের ধারা বাতিলের আহ্বান জানান। অন্য একজন যাজক বলেন, তার কল্পিত ‘আদর্শ বিশ্বে’ ভোট হবে পরিবারভিত্তিক, অর্থাৎ পরিবারের পক্ষ থেকে একজনই ভোট দেবেন। ভিডিওতে এক নারী সদস্যকেও দেখা যায়, যিনি প্রকাশ্যে স্বামীর প্রতি নিঃশর্ত অনুগত থাকার কথা বলেন।
হেগসেথ এই ভিডিওর সঙ্গে লেখেন— ‘All of Christ for All of Life’। এর অর্থ, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ও সমাজের প্রতিটি স্তরে খ্রিষ্টান ধর্মীয় নীতি ও বিশ্বাস প্রয়োগ করা। এই দর্শনের অনুসারীরা মনে করেন, ধর্ম কেবল ব্যক্তিগত বা চার্চের ভেতরে সীমাবদ্ধ নয়, বরং রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও পারিবারিক জীবনের প্রতিটি অংশেই এর প্রভাব থাকা উচিত। ফলে হেগসেথের এই মন্তব্যকে অনেকেই চরমপন্থী খ্রিষ্টান জাতীয়তাবাদের প্রতি স্পষ্ট সমর্থন হিসেবে দেখছেন—একটি মতবাদ যা রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পূর্ণরূপে খ্রিষ্টান ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করার পক্ষে।
পোস্টটি এক্স-এ প্রকাশিত হওয়ার পর ১২ হাজারের বেশি লাইক এবং ২ হাজারের বেশি শেয়ার হয়েছে। কিছু ব্যবহারকারী ভিডিওতে যাজকদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করলেও, অনেকেই সমালোচনা করেছেন যে একজন প্রতিরক্ষামন্ত্রী, যিনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন, তার এই ধরনের মতবাদ প্রচার অনুচিত এবং উদ্বেগজনক।
প্রগতিশীল ইভানজেলিক্যাল সংগঠন ভোট কমন গুড-এর নির্বাহী পরিচালক ডগ প্যাগিট বলেন, ভিডিওতে যে মতবাদ উপস্থাপন করা হয়েছে, তা খ্রিষ্টানদের কেবল একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি। তার ভাষায়, হেগসেথের এমন পোস্ট ‘খুবই হতাশাজনক ও উদ্বেগজনক’।
বিতর্ক বাড়তে থাকায় পেন্টাগনের মুখপাত্র শন পার্নেল জানান, হেগসেথ সিআরইসি-সংশ্লিষ্ট একটি চার্চের গর্বিত সদস্য এবং উইলসনের অনেক লেখা ও শিক্ষাকে তিনি গভীরভাবে মূল্যায়ন করেন।
এটি প্রথম নয়—এর আগেও হেগসেথ ধর্মীয় ইস্যুতে আলোচনায় এসেছেন। চলতি বছরের মে মাসে তিনি তার ব্যক্তিগত যাজক ব্রুকস পোটেইগারকে পেন্টাগনে আমন্ত্রণ জানান এবং সরকারি কর্মঘণ্টার মধ্যে একাধিক খ্রিষ্টান প্রার্থনা সভার আয়োজন করেন। প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা ও সামরিক সদস্যদের সরকারি ই-মেইলের মাধ্যমেই এই সভায় যোগদানের আমন্ত্রণ পাঠানো হয়েছিল।
সিএনএনের প্রতিবেদনে উইলসনের একটি মন্তব্যও উঠে আসে, যেখানে তিনি বলেন—‘আমি চাই, এই দেশ একটি খ্রিষ্টান রাষ্ট্র হোক এবং এই পৃথিবী একটি খ্রিষ্টান বিশ্বে পরিণত হোক।’
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রে নারীদের ভোটাধিকারের ইতিহাস দীর্ঘ সংগ্রামের ফল। ১৮৪৮ সালে নিউইয়র্কের সেনেকা ফলসে প্রথম নারী অধিকার সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে এই আন্দোলন শুরু হয়। এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যান্টন ও লুক্রেশিয়া মটের মতো নেত্রীদের নেতৃত্বে তৈরি হয় ডিক্লারেশন অব সেন্টিমেন্টস, যেখানে ভোটাধিকার সহ নারীর মৌলিক অধিকার দাবি করা হয়।
১৮৬৯ সালে সুসান বি. অ্যান্টনি ও স্ট্যান্টন ন্যাশনাল ওম্যান সাফরেজ অ্যাসোসিয়েশন গঠন করেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ফেডারেল পর্যায়ে নারীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা। দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯১৯ সালে কংগ্রেস ১৯তম সংশোধনী পাস করে এবং ১৯২০ সালের ১৮ আগস্ট টেনেসি অঙ্গরাজ্য অনুমোদন দিলে নারীরা ভোটাধিকার লাভ করেন।
তবে এই অধিকার বাস্তবে সব নারীর জন্য সমানভাবে কার্যকর হতে সময় লেগেছে। বিশেষ করে আফ্রিকান আমেরিকান নারীরা দক্ষিণের অঙ্গরাজ্যগুলোতে ভোট দেওয়ার পথে ‘পোল ট্যাক্স’ ও ‘লিটারেসি টেস্ট’-এর মতো বর্ণবৈষম্যমূলক বাধার মুখে পড়তেন। ১৯৬৫ সালের ভোটিং রাইটস অ্যাক্ট পাস হওয়ার পর এসব বৈষম্যমূলক প্রথা বিলোপ হয় এবং সব বর্ণ ও জাতির নারীর জন্য ভোটাধিকার পুরোপুরি নিশ্চিত হয়।