শিরোনাম
লাইফস্টাইল ডেস্ক
প্রকাশ: ১৭:৪১, ২৬ মে ২০২৫
জন্মদিন উপলক্ষে পরিবারে কোনও আয়োজন না হওয়াটা ছিল একটা কারণ, তবে আসল বিষয় ছিল অনেক গভীর। সারাহ অভিযোগ করেন, তার মা ছিলেন ঠাণ্ডা মেজাজের, আত্মকেন্দ্রিক এবং সারাহর জীবনে অনাগ্রহী। শিক্ষাজীবনে অবহেলা, পারিবারিক কৃষি খামারে কাজের চাপ—এসব তো ছিলই। কিন্তু সবচেয়ে বেশি যেটা আঘাত দিয়েছিল, তা হলো—তার মা কোনও দিনই তাকে রক্ষা করেননি এক কর্তৃত্বপরায়ণ ও মাঝে মাঝে নির্যাতনকারী বাবার হাত থেকে।
দুই-তিন বছর তাদের মধ্যে কোনও যোগাযোগ ছিল না। সারাহ বলেন, ‘সেই সময়টা আমার কাছে ছিল মুক্তির মতো।’ তবে বিদেশে পাড়ি জমানোর আগে সম্পর্কের তিক্ততা মেটাতে আবার যোগাযোগ করেছিলেন তিনি। কিন্তু তিনি বলেন, তার মা-বাবা যেন কিছুই ঘটেনি এমন ভাব করছিলেন। এরপরের দুই দশকেও বেশ কয়েকবার বিচ্ছেদ হয়েছে তাদের।
গবেষণা বলছে, বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্কচ্ছেদ যতটা অস্বাভাবিক মনে করা হয়, ততটা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ৮,৫০০ জন মানুষের উপর ২০২২ সালে করা এক জরিপে দেখা গেছে, ২৬ শতাংশ কখনো না কখনো বাবার সঙ্গে ও ৬ শতাংশ মায়ের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদে গিয়েছিলেন। জার্মানির এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৩ বছরে ২০ শতাংশ উত্তরদাতা বাবার সঙ্গে ও ৯ শতাংশ মায়ের সঙ্গে এমন দূরত্বের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন।
কর্নেল ইউনিভার্সিটির সমাজতত্ত্ববিদ কার্ল পিলেমার জানান, অনেক সময় তীব্র শারীরিক নির্যাতন না থাকলেও ছোট ছোট মানসিক যন্ত্রণা, আত্মিক দুরত্ব, এবং বারবার নেতিবাচক আচরণ থেকেও গড়ে ওঠে এই বিচ্ছেদ। অনেক ক্ষেত্রেই এটি ঘটে বিবাহবিচ্ছেদ, নতুন সঙ্গীর আগমন, পারিবারিক রাজনীতি, বা সন্তানের যৌন পরিচয়ের প্রতি অগ্রহণযোগ্যতা থেকে।
ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট জোশুয়া কোলম্যান বলছেন, বর্তমান সমাজে বাড়ছে ব্যক্তি স্বাধীনতার চর্চা। ‘নিজের সুখ, নিজের পরিচয়কে সর্বাগ্রে রাখার প্রবণতা বাড়ছে। তাই সম্পর্কের গুরুত্ব হ্রাস পাচ্ছে।’ তিনি বলেন, থেরাপিস্ট ও সোশ্যাল মিডিয়া অনেক সময় ‘টক্সিক’ সম্পর্ক থেকে মুক্তির পরামর্শ দিয়ে থাকেন—যা এই বিচ্ছেদের প্রবণতাকে উৎসাহ দেয়।
অন্যদিকে, ইউনিভার্সিটি অব দ্য ওয়েস্ট অব ইংল্যান্ডের মনোবিজ্ঞানী লুসি ব্লেক বলেন, ‘অনেক সময় আমরা শুধু শারীরিক নির্যাতনের কথা বলি, কিন্তু মানসিক অত্যাচারও এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হতে পারে।’
তার গবেষণায় অংশ নেওয়া ৮০০ জন ব্রিটিশ নাগরিকের মধ্যে বেশিরভাগই সম্পর্কচ্ছেদের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন মায়ের কঠোর, কর্তৃত্ববাদী এবং অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণকে। তিনি বলেন, ‘কেউ যদি নিজের পরিবারের সঙ্গে নিরাপদ না অনুভব করে, তবে সেই সম্পর্কে থাকার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই।’
গবেষক পিলেমার বলছেন, অনেক সময় সন্তানদের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কিন্তু পরবর্তীতে অনুশোচনা তৈরি হয়। এমনকি সম্পর্কচ্ছেদ করা ব্যক্তিরাই আবার পুনর্মিলনের পথ খুঁজে ফেরেন।
তিনি জানান, “একজন মা বলেছিলেন, তাঁর সন্তান তাঁকে ত্যাগ করেছে কারণ তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলেন, যেখানে সে ছিল কম নিরাপদ। কিন্তু সেই সন্তান পরবর্তীতে বুঝেছিল, ৬০-এর দশকে একা মা হওয়া কতটা কঠিন ছিল।”
গবেষকরা মনে করেন, শৈশবের স্মৃতি সব সময় নির্ভরযোগ্য হয় না। অতীতের ঘটনাও বদলে যায় আমাদের বর্তমান উপলব্ধির উপর ভিত্তি করে। একজন বাবা-মা হয়তো তার সন্তানকে সর্বোচ্চ দিয়েই বড় করেছেন, কিন্তু সন্তানের দৃষ্টিকোণে সেটি যথেষ্ট ছিল না।
সাইকোলজিস্ট কোলম্যান বলেন, "অনেক সন্তান তাদের মাকে অভিযুক্ত করে বলেন, আপনি তো সব সময় কাজেই ব্যস্ত ছিলেন, সময় দেননি। কিন্তু সেই মা হয়তো দুইটা চাকরি করে একাই সংসার চালিয়েছেন।"
সম্পর্কচ্ছেদ কি সত্যিই মানুষকে সুখী করে তোলে? অনেকেই বলেন, হ্যাঁ—তারা আরও হালকা বোধ করেন, মানসিকভাবে সুস্থ থাকেন। তবে অন্যদিকে—বিচ্ছিন্ন মা-বাবাদের জন্য এটি হয় চরম কষ্টদায়ক, বেদনার।
লুসি ব্লেক বলেন, "যদি আপনি এই পথেই এগোতে চান, তাহলে মানসিক প্রস্তুতি নিন। নিজেকে ভালোভাবে গুছিয়ে নিন—কেননা এই বিচ্ছেদ উৎসবের দিনগুলোতে আরও একাকীত্ব এনে দিতে পারে।"
এবং এক প্রশ্ন থেকেই যায়—যদি কাল সকালে সেই বাবা বা মা না থাকেন, তাহলে আপনি কি আজকের সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট থাকবেন?
ঢাকা এক্সপ্রেস/ এমআরএইচ